পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ৩নং দেউলবাড়ী দোবড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং উপজেলার মধুভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়ালীউল্লাহের অত্যাচারে অতিষ্ট ৫ হিন্দু শিক্ষক। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী এমপি থাকাকালীন তার খুব কাছের লোক ছিলেন ওয়ালীউল্লাহ। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সরাসরি সাঈদীর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। সাঈদী এমপি থাকাকালে তাকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে ভূড়ি ভোজেরও আয়োজন করেন তিনি। ২০০৮ সালে পিরোজপুর-১ আসনে সাঈদী পরাজিত হলে এ ইউপি চেয়ারম্যান অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েন। সু-চতুর এ চেয়ারম্যান কৌশলে স্থানীয় সরকারদলীয় সাংসদ একেএমএ আউয়ালের সান্নিধ্য লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতা বনে যান। এমপি’র আশির্বাদ নিয়ে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি আবারো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ৩নং দেউলবাড়ী দোবড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং উপজেলার মধুভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
সর্বস্ব বিলিয়ে তার ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। তারমধ্যে অন্যতম হলো তার প্রতিষ্ঠিত ওই বিদ্যালয়ের ৫ হিন্দু শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একটি জালিয়াতির মামলা। ওই ইউপি চেয়ারম্যানের জালিয়াতির শিকার হয়ে আদালতের আশ্রয় নেন সংখ্যালঘু ওই ৫ স্কুল শিক্ষক। ১৫ বছর মামলা লড়ে তারা নিম্ন আদালতসহ উচ্চ আদালতের রায় পেয়েও কর্মস্থলে পুনর্বহাল হতে না পেরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে সংখ্যালঘু ওই ৫টি পরিবার।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী উপজেলার মধুভাঙ্গা গ্রামে বেগম মতিউন্নেছা নিম্ম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা লগ্নে চেয়ারম্যান ওয়ালিউল্লাহ ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং অরুনা গাইন, সমীর দে, জগদীশ চন্দ্র সুতার, স্বপন কুমার শিকদার ও গৌরী বৈরাগী সহকারী শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন উপ-পরিচালক সরেজমিনে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনের প্রতিষ্ঠা কালীন নিয়োগ পাওয়া উল্লেখিত শিক্ষকদের নাম উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ৩রা নভেম্বর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যালয়টি নাম পরিবর্তন করে স্থানের নামানুসারে ‘মধুভাঙ্গা নিম্ম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়।
১৯৯৪ সালের ১লা জানুয়ারী বিদ্যালয়টি একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং ২০০০ সালের ১লা জানুয়ারী অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। ইতিপূর্বে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির ০৩/৯৬ নং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর কমিটির ১৮/৯৭ নং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাক্ষাতকার বোর্ড গঠণ করা হয় । ওই সাক্ষাতকার বোর্ড ১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কালীন নিয়োগ দেয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ পূর্বক তাদের চাকুরী বৈধকরণের সুপারিশ করলে পরিচালনা কমিটির ২০/৯৭ নং সভায় তাদের নিয়োগ বৈধ করা হয়। ওই বছরে বিদ্যালয়টি এমপিও তালিকা ভুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ স্বাক্ষরিত বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুমোদিত নামের তালিকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবরে প্রেরণ করেন। ওই তালিকায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে অরুনা গাইন, সমীর দে, জগদীশ চন্দ্র সুতার, স্বপন কুমার শিকদার ও গৌরী বৈরাগীর নাম অন্তভুক্ত ছিল। তখন বিদ্যালয়টি এমপিও তালিকা ভুক্ত হয় নাই। এছাড়া ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকাবস্থায় অরুনা গাইন, সমীর দে, জগদীশ চন্দ্র সুতার, স্বপন কুমার শিকদার ও গৌরী বৈরাগী ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটানিং অফিসার কর্তৃক নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালের ২২ মে তারা তাদের বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হয়েছে বলে জানতে পারেন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেন এমপিও তালিকায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাদের নাম উল্লেখ নাই। সেখানে তাদের স্থলে প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ’র স্ত্রী শাহনাজ পারভীনসহ শ্রাবনী হালদার, প্রনব কান্তি অধিকারী, সাইফুল ইসলাম, সবিতা মল্লিক, সেবিকা মল্লিকের নাম রয়েছে। অথচ তাদের কখনও ওই বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এমনকি তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমপিও তালিকাভুক্ত হওয়ার পূর্বে কখনও বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনি। প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসা বৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক অরুনা গাইন, সমীর দে, জগদীশ চন্দ্র সুতার, স্বপন কুমার শিকদার ও গৌরী বৈরাগীর নাম বাদ দিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের স্ত্রী শাহনাজ পারভীনসহ শ্রাবনী হালদার, প্রনব কান্তি অধিকারী, সাইফুল ইসলাম, সবিতা মল্লিক, সেবিকা মল্লিকদের ওই বিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী দেখিয়ে এমপিও ভুক্তির জন্য তাদের নামের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেছেন।
এ ঘটনায় বৈধ নিয়োগ প্রাপ্তরা ২০০২ সালের ২২জুন নাজিরপুর সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানী মামলা নং-৪৫/২০০২ দায়ের করেন। এ মামলার বিচার শেষে ২০০৭ সালের ২২ অক্টোবর পিরোজপুরের সহকারী জজ মো. জাহিদুল করির ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ’র স্ত্রী শাহনাজ পারভীনসহ শ্রাবনী হালদার, প্রনব কান্তি অধিকারী, সাইফুল ইসলাম, সবিতা মল্লিক, সেবিকা মল্লিকের নিয়োগ বে-আইনী ও বাতিল ঘোষণা করেন। তাদের পরির্বতে অরুনা গাইন, সমীর দে, জগদীশ চন্দ্র সুতার, স্বপন কুমার শিকদার ও গৌরী বৈরাগীর নাম এমপিও ভুক্তসহ আইনত তাদের প্রাপ্য ভাতাদি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের আদেশ প্রদান করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক ওয়ালীউল্লাহ পিরোজপুর জেলা জজ আদালতসহ মহামান্য হাইকোর্টে আপীল করলেও উভয় আদালত নিম্ন আদালতের দেয়া উল্লেখিত রায় বহাল রাখেন। দীর্ঘ ১৫ বছর মামলা পরিচালনা করে উচ্চ আদালতের রায় পেয়েও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে বৈধ নিয়োগ পাওয়া ওই ৫ সংখ্যালঘু শিক্ষক।
রবিবার বিকেলে নিজ বাড়ীতে কথা হয় জালিয়াতির শিকার হওয়া শিক্ষক সমীর দে’র সাথে তিনি বলেন, নিজেদের টাকা-পয়সা খরচ করে শ্রম দিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। বিনা পয়সায় ১০ বছর শ্রমও দিয়েছি। কিন্তু যখন বিদ্যালয়টি এমপিও হবে তখন প্রধান শিক্ষক আমাদের নাম বাদ দিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তার স্ত্রীসহ নিজের লোকদের নিয়োগ দেখিয়ে তাদের নামে এমপিও করিয়েছে। অবৈধভাবে আসা শিক্ষকরা আজ সরকারী বেতন ভাতা পাচ্ছে। বিএ পাশ করেও আজ আমাকে দিন মজুরের কাজ করতে হচ্ছে। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌছেছি। আমাদের মধ্যে একজনের চাকুরী থেকে অবসরে যাওয়াও সময় শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। ৫টি পরিবার আজ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। উচ্চ আদালতের রায় পেয়েও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা আরো হতাশ হয়ে পড়েছি। শুনছি প্রধান শিক্ষক টাকা দিয়ে সব ঠিক করে ফেলেছে। উচ্চ আদালতের রায়েও আমাদের কোন গতি হবে না।
ওই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর পর্যন্ত পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করা মধু সুদন বালা বলেন, আমার যা বলার আদালতে বলেছি। যারা মামলা করেছে আমি নিয়োগ বোর্ডে থেকে তাদের নিয়োগ দিয়েছি। তারাই বৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক। পরবর্তীতে তাদের বাদ দিয়ে আমার স্বাক্ষর জাল করে অন্যদের নিয়োগ দেখানো হয়েছে।