প্রাচীন সভ্যতাগুলোর বেশির ভাগ গড়ে উঠেছিল এশিয়ায়। মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলনীয়, সিন্ধু, সুমেরীয়, পারস্য, চৈনিক ও অ্যাসেরীয় সভ্যতার সবগুলোই এশিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে এশিয়ার আরেকটি সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কমই জানি। সেটি হচ্ছে ‘গান্ধার সভ্যতা’।
এই সভ্যতার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বর্তমান সময়ে গান্ধার সভ্যতার যেসব নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। গান্ধার সভ্যতা মূলত গ্রিক সভ্যতার সমসাময়িক। এর স্থাপত্যকলার সঙ্গেও চমৎকার মিল রয়েছে গ্রিক সভ্যতার স্থাপত্যকলার। এ কারণে একটা প্রশ্ন সব সময় থেকে গেছে- গ্রিকরা গান্ধারে প্রভাবিত ছিল, নাকি গান্ধার গ্রিকদের দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে এখনো নৃবিজ্ঞানীদের কাছে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত নেই।
প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের অবস্থান ছিল বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডি এবং আফগানিস্তানের পূর্বাংশজুড়ে। গ্রিকরা গান্ধারকে বলত ‘গান্ডারীর নগর’। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা। শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল তক্ষশীলা। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পারস্যের সম্রাট সাইরাস গান্ধার জয় করেন। পারস্য সম্রাট দারিয়ুসের বেহিস্তান শিলালিপিতে (খ্রিস্টপূর্ব ৫২০-৫১৮) গান্ধারের অধিবাসীদের আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রজাদের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস পারস্য সৈন্যবাহিনীতে ‘সুতি কাপড় পরিহিত’ ভারতীয় সৈন্যের উল্লেখ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারতে আসে তখন রানী ভিক্টোরিয়া লর্ড ক্লাইভকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, তারা যাতে গান্ধারদের কাছ থেকে দূরে থাকে। তার অনেক পরে হলেও আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী হামলা চালিয়েছিল, যার মধ্যে ব্রিটিশ সৈন্যরাও ছিল। সেই যুদ্ধ আজো চলমান।
গান্ধার সভ্যতার নিদর্শনগুলোর অধিকাংশই পাথরে নির্মিত। নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন, যে সময়ে ওই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়েছিল তা ওই অঞ্চলের শিল্পীদের নৈপুণ্যকে নির্দেশ করে। অনেক আগে থেকে গান্ধারের মানুষ পাথর দিয়ে নির্মিত তৈজসপত্র এবং হাতিয়ার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। এছাড়া বর্তমান পেশোয়ারে এমন কিছু পাথুরে অস্ত্র পাওয়া যায়, যা কার্বন ডেটিং করে দেখা যায়, গান্ধারের বয়সের তুলনায় অনেক প্রাচীন ওই অস্ত্রগুলো। অনেক গবেষক মনে করেন, অস্ত্র হিসেবে পাথর ব্যবহারের আবিস্কার করেছিল প্রাচীন গান্ধারবাসী।
গান্ধার সভ্যতার প্রথান শহর ছিল ‘পুরুশাপুরা’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘মানুষের শহর’। এই জায়গাটিই বর্তমানে পেশোয়ার নামে পরিচিত। মহাভারত ও রামায়নেও গান্ধার সভ্যতার কথা উল্লেখ আছে। নৃবিজ্ঞানীরা অনেকে গান্ধার বলতে ‘সুঘ্রানের শহর’ বলে থাকেন। তবে ইতিহাসবিদদের দাবি, হিন্দুকুশ পর্বতমালার ওই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এমন যে সেখানে পুষ্পময় কোনো সময় ছিল কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
অবশ্য ভাষা বিজ্ঞানীরা ‘সুঘ্রান’ শব্দটির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। সেই সময় গান্ধারের ভাষা ছিল মূলত প্রাকৃত অথবা মধ্য ইন্দো-আর্য। এছাড়া গান্ধারি নামেও একটি উপভাষা প্রচলিত ছিল ওই অঞ্চলে। বর্তমানে পাকিস্তানের পেশোয়ারসহ বেশ কিছু অঞ্চলে গান্ধারি ভাষাভাষী কিছু মানুষ পাওয়া যায়।
গান্ধার রাজ্যের স্থায়ীত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকে এগার শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। বৌদ্ধ কুসান রাজা এক থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত গান্ধারের রাজত্ব করেন। ওই সময়টাকে গান্ধারের ‘সোনালী সময়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কুসান রাজার সময়ে গান্ধারে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পরে গান্ধার চলে যায় হানদের দখলে। এরপর বৌদ্ধ ধর্ম বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। অনেক বছর চলে হিন্দু ধর্ম চর্চা। মহাভারত ও রামায়নে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন গান্ধার রাজ্য বিভিন্ন শাসকের অধীনে শাসিত হয়েছে। গ্রিক মহাবীর আলেকজেন্ডারও গান্ধার অধিগ্রহণ করেছিলেন। যদিও কেউই ভালোভাবে শাসন করতে পারেনি। তবে সর্বশেষ গান্ধার মুসলিমদের অধীনে চলে যায়। তখন থেকে গান্ধার নামটি বিলুপ্ত হতে থাকে এবং স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন শুরু হয়। এ কারণেই বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পেরেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে আলেকজেন্ডার ব্যাকট্রিকা এবং বুখারা জয় করে সির দরিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর হিন্দুকুশ পাহাড়ের পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মে মাসে সিন্ধু নদের নিকটে পৌঁছান। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা ছিল সিন্ধু নদ ও ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। ঝিলাম নদীকে গ্রিকরা বলত ‘হাইদাসপেস’। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গান্ধারের রাজা ছিলেন ট্যাকসিলিস। তিনি আলেকজেন্ডারের জন্য মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠান। তার মৃত্যুর পর অম্ভি গান্ধারের রাজা হন। অম্ভিও আলেকজেন্ডারকে ৬৫টি হাতি এবং ৩০০ ষাঁড় উপহার দেন।
একটি নগর সভ্যতা হিসেবে গান্ধারে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, যা আমাদের আধুনিক সভ্যতার সঙ্গেও মিলে যায়। যেমন আমরা ইউরোপে যে ক্রসরোড বা আড়াআড়ি রাস্তা দেখি, নৃতাত্ত্বিকরা গান্ধারেও সেরকম বেশকিছু ক্রসরোডের সন্ধান পেয়েছেন। আর সে সময়টায় বলা যায়, ইউরোপ আলো জ্বালাতেও শিখেনি।