আজ ২৩ মার্চ আমার মায়ের মৃত্যুর দিন। আমাদের মা, ইসকুলে পড়া কালে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমরেড প্রসাদ রায়ের সাথে। বিয়ের আসরে মা দেখলেন বরের পান্জাবীতে একটা বোতাম নাই, বিয়ের ঘটক সেলিনা বানুর ইঙ্গিতে রাষ্ট্রভাষা মতিন নিজের জামাতে লাগানো একটা সেফটিপিন খুলে দিলেন বন্ধুকে- সেই থেকে একটি রাজনৈতিক মানুষের সাথে তার যৌথ জীবন আর দুজনের সবার জন্য লড়াইয়ের শুরু।
পাকিস্তানের পুরোটা সময়ই প্রায় বাপী ছিলেন জেলখানায়, সদ্যজাত অপরাষ্ট্র পাকিস্তানে প্রতিটি দিন তাই মায়ের কেটেছে অসম্ভব শংকায়। মায়ের প্রথম সন্তান মারা গেছে নিজের কোলে- স্বামী পাকিস্তানের জেলে বন্দী। শিশু কলেরায় আক্রান্ত বাচ্চাটা একসময় তার কোলেই মারা গেলো। শিশু কলেরার ২৪ টাকার একটা ইনজেকশন কেনার সামর্থ আমার মায়ের সেদিন ছিলো না।
যে শিশুটির কয়েকদিন পরে মুখেভাত হওয়ার কথা সেই শিশুটি লাশ হয়ে গেলো- আমার অসহায় সামর্থহীন মায়ের কোলেই। সত্যি হলো আমার পিতা প্রসাদ রায় তার প্রথম সন্তানের মুখটিও দেখতে পারেন নাই- আমাদের দাদা গৌতমের জন্মের কয়েকদিন আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। আমাদের জন্মের পরেও দেখেছি মায়ের লড়াই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ১৯৭৫ এর ২০ আগষ্ট বাপী গ্রেফতার হলেন মায়ের চাকরীটা গেলো বিনা কারনে- সামান্য দোকান ভাড়া আর উঠোনের সব্জিতে আমাদের বেড়ে ওঠা। এটা ডিমের মধ্যে দিয়ে সুতোর নিপুন বিভাজন। নিখোঁজ স্বামীর সন্ধানে মায়ে যুদ্ধযাত্রা। এসব দেখেই কেটেছে কৈশর।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে মা ছিলেন পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসার কাকিমা। বাপী যখন ভারতের করিমপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের পরিচালক। তখন মা একদিকে বাপীকে সাহস দিয়েছেন, অন্যদিকে আগলে রেখেছেন সন্তান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে বাপী যখন জেলখানায়, তখন মাকে তার শিক্ষকতার চাকরী হারাতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হওয়ায়। তবু আপোষ করেননি আমাদের বাপী- করেননি আমাদের মা। তাই বাপী অবলীলায় ২০ বছর কাটিয়ে গেছেন জেলখানায়, মা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়েছেন।
সময় ক্রমশ দ্রুতগামী হয়- মা চলে গেছেন ২০০১ এর আজকের দিনটিতে। এখন ২০১৮। সময়ের রোলার কোষ্টারের যাত্রী হয়ে চলেছি আমরা- মনে পড়ছে ৯৫ তে যখন বিটিভির চালচিত্র অনিুষ্ঠানটিতে আমাকে কয়েক মিনিট দেখাতো- তখন প্রবল আগ্রহে মা দেখতেন। ফোন দিতেন স্বজনদের দেখার জন্য। সময় আরো দ্রতগামী- এখন অনেক মানুষের ভালোবাসা আর ঘৃণা নিয়ে আমি নিয়মিত টেলিভিশনে। ২৪ ঘন্টায় ২ ঘন্টার উপস্থিতি। অনেকেই দেখে- আমি আমি জানি মা তুমি দেখো না। না দেখো আপত্তি নাই- শুধু এটুকুই বলি- যুদ্ধটা তোমার কাছে থেকেই শিখেছি- চাপাতি বা রাজ অনুগ্রহ এই দুটোর স্পর্শ থেকেই যেনো দূরে থাকতে পারি- সেটাই আশির্বাদ করো তুমি মা।
পাবনা শহরে মা ছিলেন প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দেলনের সাথে। পাবনার সম্মিলিত সাংস্কৃতির জোটের সভাপতি, জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ও পাবনা সেন্ট্রাল গার্লস স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছের একই সাথে। জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালের বামে আমার মা মীরা রায়। ছবিটি মহিলা পরিষদের কোন আয়োজনের। পরের ছবিটা বাপী, মা, দিদিভাই আর আমি। তার পরের ছবিটা গীতাকে পাবনায় বরণ করে নেয়ার, শেষ ছবিটাতে মায়ের বেডরুমে আমি।