*৬৪ নদীর ৩৭টি অস্তিত্বহীন
*বন্ধ হয়ে গেছে ২৮ নৌ-রুট
*নদী আছে নাব্যতা নেই
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি। দুইধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা স্কুলজীবনে পা দিয়েই পড়েননি এমন মানুষ খুবই কম আছে। যদিও এখন প্লে, প্রি ক্লাসে গিয়ে পড়তে হয় টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার কিংবা হামটি ডামটি…….। তাই বর্তমান প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা। মানচিত্রেও এখন আর অনেক নদীর নাম দেখা যায়না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখ মাসে নাগর নদী দেখে কবিতাটি লিখেছিলেন। এখন আর ছোট নদী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ও দখলের কারণে বৈশাখ মাসে দেশের অন্যতম প্রমত্তা নদীগুলোতেও পানি থাকেনা। পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় ¯্রােত কমে শাখা নদীগুলোতে পলি জমায় ¯্রােতহীন হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। যে কারনে পানিশূন্য হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের তিন হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ এখন মরণফাঁদে রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথ ইতোমধ্যে নাব্যতা হারিয়ে নৌ-যান চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পরেছে। নাব্যতা সংকটের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে এ অঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট। আরও তিনটি রুট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে যাতায়াতের সহজ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা ও ৪০টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষকে নৌ-পথ কিংবা ৮৮টি নৌ-রুটের ওপর ভরসা করেই যাতায়াত করতে হয়।
বিআইডব্লিউটিএ’র হিসেবে প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক লোক এসব নৌ-রুটে যাতায়াত করে থাকেন। প্রতিবছর চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এ অঞ্চলের ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথ থাকে চলাচলের অনুপযোগী। নাব্যতা সংকটের কারণে পাঁচটি নদীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নৌ-চলাচল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব অঞ্চলের ব্যবসায়ীক বন্দরগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাব্যতা সংকটে নদীর বিভিন্ন অংশে অসংখ্য চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা চরে স্থানীয়রা ধানসহ অন্যান্য চাষাবাদ করছেন। এছাড়াও নাব্যতা সংকটে জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীটিও এখন মরা খালে রূপ নিয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চৈত্রের শুরু থেকে বৈশাখের খরতাপে এবং মরণবাঁধ ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে দেশের শ’খানেক নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে শুধু নদী নয়, খাল-বিল, পুকুর-দীঘির সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার পরে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ মৌসুমে সাধারণ হস্তচালিত নলকূপ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। নগরায়ন ও অবৈধ দখলের কারণে বরিশাল নগরীর বড় বড় দীঘি-পুকুর ও খালের বিশাল অংশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। নগরীতে একসময়ে সু-বিশাল দীঘি-পুকুর আর জালের মতো ছড়িয়ে ছিল খাল। সেসব আজ অস্তিত্ব হারিয়েছে। ফলে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে নগরবাসীকে পানির জন্য প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার মুলাদী উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা জয়ন্তী নদীর পানি কমে গেছে। ওই নদীর বালুচরের একটু শক্তস্থানে পিচ বানিয়ে দামাল ছেলেরা মেতে ওঠে ক্রিকেট খেলায়। নৌকাগুলো আটকে রয়েছে বালুচরের এখানে সেখানে। জেগে ওঠা চর থেকে বালুগুলো খুবলে খুবলে তুলে নিচ্ছে বালু খেকোরা। নাব্যতা সংকটের কারনে অনেকেই ফারাক্কার বাঁধকে দায়ি করলেও যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ফারাক্কা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে গত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পাচ্ছে তা গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যার চেয়ে অনেক বেশি। তার পরেও নদীর করুন অবস্থা নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য তথ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১৪’শ কিলোমিটার নয়; সারাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব নৌ-রুটগুলোকে সচল রাখতে নৌ-মন্ত্রণালয় থেকে বছরের বারো মাসই ড্রেজিং অব্যাহত থাকলেও নৌ-পথকে সচল রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নদীতে এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচলের জন্য কমপক্ষে ৮/৯ ফুট পানি প্রয়োজন, ডাবল ডেকার লঞ্চের জন্য প্রয়োজন ১৪/১৫ ফুট পানি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় চৈত্র ও বৈশাখ মাসে অব্যাহতভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পানি কমতে থাকে। একইসাথে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলের শাখা নদীগুলো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশালের শহরতলি এলাকায় তালতলী নামে একটি নদী ছিল। একসময় এই তালতলী নদী দিয়ে স্টিমার, বড় মালবাহী নৌযান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতো। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও নদীতে থৈ থৈ করত পানি। ঢেউয়ে ছিল বাঘের গর্জন। কিন্তু আজ নাব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে তালতলী নদী। এখন সেই নদী শুধু কল্পকাহিনী। শুধু তালতলী নদীই নয়, কালসুরী, জয়শ্রী, চন্দ্রমোহন, কালিজিরা, তুষখালী, খয়রাবাদ, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়ালখাঁ, পালরদী নদী, পটুয়াখালীর পাঙ্গাশিয়া, আলগী, আলকি নদীর মতো এমন নাম না জানা নদী এখন বয়োবৃদ্ধদের মুখে গল্পকথায় পরিণত হয়েছে।
নদী কমিশনের হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের ৬৪ নদীর মধ্যে ৩৭টি নদী এখন অস্তিত্বহীন। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, কালাবদর, লতা, কীর্তনখোলা, বিষখালী, বরগুনা, রাঙ্গামাটিয়া, নয়াভাংগনী, আমতলী, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর, সাতলা, আগরপুর, আড়িয়াল খাঁ, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, আগুনমুখ, রাবনাবাদ, কারখানা, লোহালিয়া, বিঘা, বুড়িশ্বর, আন্ধারমানিক, খয়রাবাদ, ইলিশা ও গাবখান নদীর নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও ৩৭টির কোনো হদিস নেই। এরমধ্যে বরগুনা, নয়াভাংগনী, সাতলা, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া ও ইলিশা নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে।
অপরদিকে পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনা থেকে উৎপত্তি তেঁতুলিয়া নদী এখন শুধুই একটি খাল। সাহেবের নদী ও চন্দ্রমোহন নদীরও একই অবস্থা। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীও এখন মরার পথে। কালসুরী নদী দিয়ে ছিল খুলনাগামী নদীপথ। আজ আর কালসুরীর দেখা মেলেনা। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের নন্দিবাজার এলাকার জয়শ্রী নদী এখন মরা খাল। মেঘনা নদীর শাখা এমন ৭-৮টি নদী মরে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ নৌযান দুইঘন্টা পথ ঘুরে যেতে হয়। সূত্রমতে, চৈত্রের শুরু থেকে বৈশাখ মাসে এসব নদীর পানি কমে নদীতে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। পানি কমে যাওয়ায় বরিশাল থেকে ঢাকাগামী ভাষানচর ও চরনাইন্দা, পয়সারহাট থেকে ঢাকাগামী মীরেরহাট, বিষারকান্দি-হারতাসহ মেহেন্দিগঞ্জের কয়েকটি চ্যানেলের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পরেছে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বরিশাল-ভোলা নৌ-রুট। ওই রুটের সাহেবেরহাট ও লাহারহাট পয়েন্টে নাব্যতা কমে যাওয়ায় দুধল, দাঁড়িয়াল, বাকেরগঞ্জ, চরামদ্দি, বলাইকাঠী, চন্দ্রমোহন, বুখাইনগর, মেহেন্দিগঞ্জ রুটের লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হতে চলেছে। বরিশাল-ভোলা রুটের লঞ্চগুলোকে বিকল্প পথে লাহারহাট অথবা চরমোনাই হয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। পালরদী নদীর টরকী থেকে এখন আর সরাসরি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছেনা কোন যাত্রীবাহি লঞ্চ। এককালের ভয়ঙ্কর পালরদী নদীর নাব্যতা সংকটের কারনে গত ছয়মাস ধরে লঞ্চগুলোকে টরকী থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরত্বে কয়ারিয়া নামক এলাকায় নোঙ্গর করতে হচ্ছে। অথচ একসময় পালরদী নদীতে সরাসরি কোলকাতা থেকে জাহাজ ও স্টীমার আসা-যাওয়া করতো, সেসব এখন ¯্রফে গল্পের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নদীটির কারনেই টরকী, গৌরনদী ও পিঙ্গলাকাঠীতে গড়ে ওঠে ব্যবসায়ীক বন্দর। নদীর নাব্যতা সংকটে নৌ-যান চলাচল করতে না পারায় বন্দরের ব্যবসায়ীরা সহজে মালামাল পরিবহন ও পাইকাররা নৌ-পথে বন্দরে আসতে না পারার কারনেই ঝিমিয়ে পরেছে ওইসব বন্দরের ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক মাস থেকে পালরদী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং কাজ অব্যাহত রয়েছে। একই অবস্থা সুগন্ধা নদীর মীরেরহাট ভায়া হারতা-পয়সারহাট নদীর। ওই নদীর অধিকাংশ এলাকায় অসংখ্য চর জেগে ওঠায় নৌ-যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নদীর তীরবর্তী পয়সারহাট ও হারতা বন্দর দুটির ব্যবসায়ীরাও ঝিমিয়ে পরেছে।
ঢাকা-বরিশাল রুট কিংবা বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের জন্য নেই কোন বিকল্প চ্যানেল। ফলে এসব রুটের বড় নৌ-যানকে এ মৌসুমে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করেই যাতায়াত করতে হচ্ছে। অপরদিকে এসব নদী ভরা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে হয়ে ওঠে বিপদজনক। কারণ শাখা খালগুলো বিলীন থাকায় নদীগুলো পানির চাঁপ ধারণ করতে না পারায় অনাকাংখিত ¯্রােত ও নদীপাড় ভাঙ্গন কবলিত হয়ে পরে।
নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ঝালকাঠীসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কপথে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্প কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকরা হয়ে পরছেন বেকার। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে নদীর ওপর ভিত্তি করে এ অঞ্চলে নির্মিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট), সঞ্জুরী প্রজেক্ট, মধুমতি-মাদারীপুর বিল রুট ক্যানেল সেচ প্রকল্প (এমবিআর প্রজেক্ট), বরিশালের উজিরপুর ও আগৈলঝাড়ার সাতলা-বাগধা সেচ প্রকল্প, বরিশাল-ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের ইরিগেশন প্রকল্পসহ অসংখ্য সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পরেছে। বছরের পর বছর প্রকল্পভুক্ত বিস্তীর্ণ ফসলী জমি অনাবাদী থাকায় উৎপাদন কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি মৌসুমে প্রতিবেশী দেশ ভারত পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারে। আবার বর্ষা মৌসুমে ওপারে বন্যার চাঁপ ঠেকাতে ফারাক্কার সব ক’টি গেট খুলে দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি একসাথে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। ফলে একসাথে প্রচুর পানির চাঁপ সামলাতে না পেরে নদীর দুু’কূল ছাপিয়ে জনপদ ফসলের ক্ষেত ডুবে বন্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেসময় নদীগুলো প্রায়ই বিপদ সংকুল ও ভয়াবহ রুপ ধারন করে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সাগর মোহনার নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ দুই দিক থেকে বেড়ে যাওয়ায় ভয়াবহ ¯্রােত এবং বাতাসের কারণে উত্তাল হয়ে ওঠে। আর ওইসময় ঘটে অহরহ নৌ-দুর্ঘটনা। যার কবলে প্রতিবারই জীবন দিতে হয় হাজার হাজার বনী আদমকে। পানি কমার সাথে সাথে শুরু হওয়া নদীর তীব্র ভাঙনে নিঃস্ব হতে হচ্ছে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নদীপথগুলো মরণ ফাঁদে পরিনত হয়েছে।
দেশে নদীর সংখ্যা কতো তা অনেকেরই জানা নেই। তবে সরকারী হিসেবে সারাদেশে নদীর সংখ্যা সাত’শ বলা হলেও বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি এটি ১৯৫৫ সালের তথ্য। অর্ধশত বছরে বেশ কয়েকটি নদী একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে। কোনটি সরু খালেও পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সার্বক্ষণিক নৌ-যান চলাচলের জন্য মাত্র ২১২টি নদীতে প্রয়োজনীয় নাব্যতা রয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোডের্র হিসেব মতে, ৩১০টি নদীর নাব্যতা রয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একসময় উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর মধ্যে ছিলো আগরপুর, পালরদী, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ, কালাবদর, আগুন মুখা, বলেশ্বর, বিষখালী, খাতাপোড়া, খাতাছেড়া, ঝুনাহার, ইলিশা, পয়সারহাট ও বুড়া গৌরগঙ্গ নদীতে বর্তমানে ¯্রােত নেই।
বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, ঋতু পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের পর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ছোট নদীগুলোতে আগাছা, কচুরিপানা ও পলি জমে ভরাট হতে থাকে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি নদীর পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় ¯্রােত কমে যাওয়ায় এসব শাখা নদীতে এর প্রভাব পরেছে। এ শাখা নদীগুলো ¯্রােতহীন হয়ে পড়ায় বর্ষায় নদীবক্ষে জমা হওয়া পলি অপসারিত হচ্ছেনা। ফলে প্রতিবছর জেগে উঠছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। নদীগুলো হারাচ্ছে নাব্যতা। পলি জমে নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলে মৎস্য সম্পদও উজাড় হতে চলেছে। মিঠা পানির কমপক্ষে ৫০ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় কৃষি, মৎস্য, পশু সম্পদ, নদীর সাথে সম্পৃক্ত শিল্প কারখানা, পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। নদী বেষ্টিত এলাকাগুলোর পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া বয়ে আনবে। হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র। সূত্রমতে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠা পানির অভাবে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের একমাত্র (খুলনা) নিউজপ্রিন্ট মিল।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং পরিদফতরের সাথে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, বছরের বারো মাসই নৌ-পথগুলোকে সচল রাখতে ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তার পরেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। একই দফতরের নৌ-পথ সংরক্ষণ বিভাগের বরিশাল আঞ্চলের এক কর্মকর্তা দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এদিকে শুকনো মৌসুমে নদীর নাব্যতা সংকট অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে নদীর উত্তাল ¯্রােত দুইমিলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য উভয় সংকট দেখা দিয়েছে। যেখানে নদীমাতৃক দেশের মানুষ নদী ও তার প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁেচ থাকার কথা সেখানে দেশের একটি বিরাট অংশ উত্তরবঙ্গের মানুষ নদীপথের কথা ভুলতে শুরু করেছে। আর দক্ষিণের জনপদের কোটি কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছাস, ঘুর্ণিঝড় আর বন্যার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন।
গত ১০ মার্চ জাতীয়নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার সরেজমিনে পালরদী নদীর কালকিনি, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদীর বিভিন্নস্থান পরিদর্শন করেন। ১১ মার্চ তিনি (মুজিবর রহমান) বরিশাল সার্কিট হাউজ মিলনায়তন সভা কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, নদীর নাব্যতা নস্ট করা যাবেনা। আমাদের মেরুদন্ডহীনের প্রাণীর মত বসে থাকলে চলবেনা। সরকার আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে নদী রক্ষার জন্য নদীর পাশে যেসব কল-কারখানা রয়েছে তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে। জেলার উজিরপুরের সাতলা-বাগধা প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষে উজিপুর, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদীর বর্তমান অবস্থা এবং স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রার ওপর এ প্রকল্পের প্রভাব শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি আরও বলেন, নদী ও খালগুলো পূর্ণ উদ্ধারের জন্য অবৈধ দখলদারদের উৎখাতের কোন বিকল্প নেই। পর্যায়ক্রমে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।