আজ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম উৎসব জামাইষষ্ঠী। এ অনুষ্ঠানটি মূলতঃ জামাইকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। যদিও জামাইবাবাজী সব সময়ই শ্বশুর বাড়িতে পরম আদরের। জামাইয়ের মঙ্গলকামনায় মূলত শাশুড়িরা বছরের একটি বিশেষ দিন পালন করে থাকে৷ এটি একটি সামাজিক প্রথা যাকে জামাইষষ্ঠী বলে পরিচিত। অন্য ভাবে দেখতে গেলে জামাইষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা৷ ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকে এর উদ্ভব৷ বৈদিক সমাজেও জামাইষষ্ঠী হত বলে শোনা যায়৷
জামাইয়ের জন্য সব সময় থাকে স্পেশাল খাবার-দাবার। দ্বীন-হীন লোকও সাধ্যমতো জামাইকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকেন।
বলা যায়- সব শ্বশুরবাড়িতে জামাইকে বসানো হয় দেবতার আসনে। জামাই তরুণ বা বৃদ্ধ যে বয়সেরই হোক না। যাতে আদরের মেয়েটিকে জামাই সারাজীবন কোনো দুঃখ-কষ্ট না দিয়ে সুখের সঙ্গে ঘর-সংসার করে।
এই দিনটি পালনে পরিবর্তন এলেও একটু পিছন ফিরে তাকালে আঁচ করা যায় জামাইষষ্ঠী পালনের মাহাত্ম ৷প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা প্রথম প্রহরে মা ষষ্ঠীর পূজার আয়োজন করে থাকে। দেবী ষষ্ঠীর প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবিকে পূজা করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য ঘট স্থাপন করেও এই পূজা সারেন। ষষ্ঠীদেবী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক৷ তিনি আবার দ্বিভুজা, দুনয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসনা, সর্বসুলক্ষণা ও জগদ্ধাত্রী শুভপ্রদা। বিড়াল হল তাঁর বাহন। ষষ্ঠীপূজার উদ্দেশ্য হল সন্তানের কল্যাণ ও সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা। ষষ্ঠী পূজার নিময় অনুসারে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস করে মায়ের পূজা সারেন। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়। আবার ঘর ও মন্দিরের বাইরে বট, করমচার ডাল পুঁতে প্রতীকী অর্থে অরণ্য রচনা করে এ পূজা করা হয়। এজন্য জামাই ষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলা যায়। পরবর্তীকালে এ পূজায় ধর্মীয় সংস্কারের চেয়ে সামাজিকতা বিশেষ স্থান পেয়েছে।
আবার বলা হয়ে থাকে এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হল কন্যার সন্তান উৎপাদনের জন্য শাশুড়ি কর্তৃক জামাইকে অভিনন্দন জানানো অথবা সেই কাজের জন্য উৎসাহিত করে জামাইয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করা। ফলে ষষ্ঠী পূজায় উপবাস করা ব্রতীরা সকালে স্নান করে আম্রপল্লব, আমসহ পাঁচফল আর ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পূজার উপকরণ সাজান। এক্ষেত্রে ধান সমৃদ্ধির প্রতীক এবং বহু সন্তানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়৷ তাছাড়া দুর্বা চিরসবুজ ও দীর্ঘ জীবনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই এমন দিনে শাশুড়ি মেয়ে-জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে ধানদুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন৷
এই বিষয়ে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অন্য একটি ব্যাখ্যাও শোনা যায়৷ পুত্র যেমন পিতার আত্মজ, কন্যা তেমনি জননীর আত্মজা৷ মানে পুত্রের মাধ্যমে যেমন পিতার পিতৃত্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকে তেমনি কন্যার মাধ্যমে মাতার জননীত্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকে৷ অর্থাৎ মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার এক ধারা এই জামাইষষ্ঠী পালনে নিহিত বয়েছে বলেও ব্যাখ্যা শোনা যায় ৷
এই প্রসঙ্গে একটি লোককথার উল্লেখ করতে হয়৷ কথিত আছে, জনৈক গৃহবধূ শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন মাছ চুরি করে খেয়ে বারবার বিড়ালের ওপর দোষ দিতেন। এরপর একদিন তার সন্তান হারিয়ে যায়৷ তখন পাপের ফল ভেবে সন্তান ফিরে পেতে সে বনে গিয়ে দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা শুরু করে। ওই গৃহবধূর আরাধনায় মা ষষ্ঠী সন্তুষ্ট হলে সেই বনে সন্তান ফিরে পায়। এই জন্যই নাকি ষষ্ঠীদেবীর অন্য নাম অরণ্যষষ্ঠী। এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার অপরাধে গৃহবধূর শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে ওই গৃহবধূর মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে দেখতে একবার ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করে এবং সেই পুজোর দিন শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য জামাইকে নিমন্ত্রণ করেন। এরপর সেই পুজো উপলক্ষ্যে সস্ত্রীক জামাই হাজির হলে মেয়েকে দেখে তার মা-বাবার মনে আনন্দ আর ধরে না৷ ৷ষষ্ঠী পুজো ঘিরে এমন ঘটনা ঘটায় বাঙালি হিন্দুসমাজে এক নতুন উৎসবের সূচনা হয়৷ কার্যত ষষ্ঠী পুজো রূপান্তরিত হয় সামাজিক অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠীতে ৷ ফলে যে পরিবারে সদ্যোবিবাহিতা কন্যা আছে, সে পরিবারে এ পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে।
বাজারের সেরা ইলিশ, পাবদা, গলদা চিংড়ি, দৈ-মিষ্টি, আম-কাঠাল দিয়ে শুধু আপ্যায়নই নয়- জামাইকে দেওয়া হয় নতুন শার্ট-প্যান্ট-কোর্টসহ বিবিধ উপহার।
অপরদিকে, কম যায় না জামাইবাবাজীর। তিনিও খালি হাতে শ্বশুরবাড়ি আসেন না, যতই আত্মভোলা হোক না কেন, শাশুড়ি মায়ের জন্য তাঁত বা জামদানি, ঝুড়ি ভর্তি আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পান-সুপুরী, নদীর ঘাট থেকে কানকো নাড়ানো পাকা রুই বা কাতল মাছ, ময়রার দোকান থেকে গরম রসগোল্লার হাঁড়ি, ছানার সন্দেশ ভর্তি বাক্স সাথে আনতে ভোলেন না।
শাশুড়ি মা যখন ‘শিব ঠাকুর’ জামাতাটিকে ধান-দূর্বা-উলু দিয়ে আশীর্বাদ করেন, জামাই বাবাজীও শাশুড়িমায়ের চরণ স্পর্শ করে, চরণধূলিটুকু আশীর্বাদ হিসেবে মাথায় তুলে নেয়।
এ সময় বাড়ির পুরুষদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। কেবলমাত্র জামাইকে খাওয়াতে উপস্থিত থাকেন বাড়ির নারীরা।
বাংলাদেশের সর্বত্র জামাইষষ্ঠীর প্রচলন আছে। এ আচারটি বেশ ঘটা করেই হয়ে থাকে।