বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা। ভাষা আন্দোলনের মাসে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে আমরা কত ধরনের প্রতিজ্ঞাই না করে থাকি! কিন্তু সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন কি আমরা করতে পেরেছি? এ ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা কি অব্যাহত রাখতে পেরেছি?
ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক পর্যায়ে ও কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তো প্রকাশ পায়-ই না, কোনো কোনো সময় অবজ্ঞার ভাবই ফুটে ওঠে। আধুনিক বা অতি আধুনিক হওয়ার জন্য শহরে বসবাসকারী কারও কারও দ্বারা ইদানীং যে বিষয় ও মূল্যবোধগুলো প্রথমেই আক্রান্ত হয়, বাংলা ভাষা সেগুলোর শীর্ষে।
আমাদের সন্তান-সন্ততি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়বে, অনর্গল ইংরেজি বলতে পারবে- এটা তো আমাদের জন্য আনন্দ ও গর্বের বিষয়। কিন্তু তাই বলে অবশ্যই বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়ন করে নয়। অনেক অভিভাবককে অহরহ বলতে শুনি- ‘আমার সন্তান, পোষ্য বা অমুক তো বাংলা জানে না।’
এ ‘জানে না’ বলার মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা থাকে। অনেকেই গালভরে বলে বেড়ান সন্তানের বাংলা না জানার বিষয়টি। ভাবখানা অনেকটা এরকম- বাংলা না জানার অর্থই হল অনেক বেশি আধুনিক এবং ইংরেজিতে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। হায়রে আমাদের মানসিকতা!
এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে যারা বাংলা লিখতে, পড়তে জানবে না, তারা কীভাবে এ দেশের মা, মাটি, মানুষের হৃদস্পন্দন অনুভব করবে? কোন যোগ্যতা নিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে? কীভাবে দেশের প্রতি তাদের মমত্ববোধ আসবে?
হ্যাঁ, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ঠিকভাবে বাংলা পড়ানো হয় না বলে অনেকেই ভালোভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারে না। আমাদের একুশের চেতনা হতে পারে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বাংলা বিষয়ের পাঠ্যসূচি সরকারি তত্ত্বাবধানে এমনভাবে প্রণয়ন করা, যেন শিক্ষার্থীরা অন্তত বাংলা লেখা ও পড়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ন্যাশনাল কারিকুলামের বাংলা ভার্সনে পড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই কারিকুলামের ইংরেজি ভার্সন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাকেন্দ্রিক তৈরি হওয়ার পার্থক্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ উচ্চশিক্ষায়, বিশেষত বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় বাংলায় লেখাপড়া করা যায় না। ওইসব লেখাপড়ার পর্যাপ্ত পুস্তক বাংলায় প্রণয়ন বা অনূদিত হয়নি। ক্লাসে শিক্ষকরা বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে পাঠদান করেন।
এতে অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে ইংরেজি বই পড়ে বোঝা এবং ইংরেজি লেকচার অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করা যায়, সেখানেও পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব রয়েছে।
লেখাপড়া ছাড়া জ্ঞানের সীমা বাড়ে না, আর মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষায় জ্ঞানচর্চা পরিপূর্ণতা পায় না। অপরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে বিশ্ব চরাচরের তুমুল প্রতিযোগিতায় শুধু পিছিয়ে যেতে হয়।
প্রতিবছর যেসব বই বা রচনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও নোবেল পুরস্কার পাচ্ছে, জ্ঞানের জগতে আলোড়ন তুলছে, সেগুলোর বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। সর্বোপরি জ্ঞানচর্চার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
কিছু কিছু ওয়েবসাইটকে জ্ঞানচর্চা ও রেফারেন্সের অত্যন্ত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলাসহ বহুবিধ জ্ঞানের একটি ইংরেজি বিশ্বকোষ। বর্তমানে প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে ২০০৮ সাল থেকে এটি অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে।
একইভাবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি ‘ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ এবং ‘ইউনেস্কো’র যৌথ উদ্যোগে ‘ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল লাইব্রেরি’ আরেকটি নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার, ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল হোমপেজ উদ্বোধনের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। এ ওয়েবসাইটটি ইংরেজি ও আরও দু-একটি ভাষায় তাদের লেখনী প্রকাশ করে থাকে।
এ দুটিসহ আরও যেসব ওয়েবসাইট বিশ্বস্ততার সঙ্গে জ্ঞান বিকাশে অবদান রেখে চলেছে, সেগুলোর বাংলা সংস্করণ চালুর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাহলে বাংলা ভাষায় গবেষণা, রেফারেন্স সংগ্রহ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
অধিকাংশ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ভুল বানান, উচ্চারণ ও ইংরেজি ঢঙে বাংলা লেখা ও বলাটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপকসহ অংশগ্রহণকারীরা ‘গ্রেট’, ‘গুডমর্নিং’, ‘গুড ইভিনিং’, ‘গুড নাইট’ বা ‘বা-বাই’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ১০ জনের কাছে নিজেকে স্মার্ট হিসেবে তুলে ধরার জন্য খুব সচেতনতার সঙ্গে বাংলার বদলে যতটুকু পারা যায় ইংরেজি বলার কসরত করে যাচ্ছেন।
পারিবারিক আভিজাত্য তুলে ধরতে এবং নিজেদের আধুনিক হিসেবে সমাজে উপস্থাপনের জন্য ইংরেজি ভাষাভাষী বা বিদেশি কেউ দাওয়াতি হিসেবে না থাকলেও ভাইবোন, সন্তানের বিয়ে ও গায়ে-হলুদের দাওয়াতপত্র ইংরেজির প্যাঁচানো ও দুর্বোধ্য অক্ষরে তৈরি করা হচ্ছে।
শহরে গায়ে হলুদের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান ইংরেজিতে সঞ্চালন করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার প্রিয় ভাষা তাদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এ ধরনের মানসিকতা পরিবর্তনে কঠিন শপথ নিতে হবে।
কোনো বিদেশির উপস্থিতি না থাকার পরও অনেক দফতরে কোনো কোনো সভা-সেমিনারের স্মার্টনেস ও গ্লামার ধরে রাখার জন্য দাওয়াতপত্র, ব্যানার, সঞ্চালন ও উপস্থাপনা ইংরেজিতে করা হচ্ছে। ফলে ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্সি না থাকায় অনেকেই কাক্সিক্ষত অবদান রাখতে পারছে না।
আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ ধরনের ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। অন্যান্য দেশে জনসাধারণ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভাষাভাষী অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতেও মাতৃভাষায় কথা বলেন, ভাব প্রকাশ করেন, এমনকি সর্বোচ্চ পদধারীরাও বিভিন্ন সভা ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় প্রয়োজনে দোভাষীর সাহায্য নেন।
আমাদেরও এ ব্যবস্থা সংযোজন করা যেতে পারে। যদি কোনো বিদেশি উপস্থিত থাকে, তাকে অনুষ্ঠানের আলোচকদের বক্তব্যের ইংরেজি তরজমা সরবরাহ করলেই তো হয়। দু-চারজনের জন্য কেন বাংলাকে পরিহার করা হবে?
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অনেক শহরে কিছু কিছু অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁর সাইন-বোর্ডে বাংলা হরফের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দফতরগুলোয় অবশ্য বহু আগেই বাংলায় ফাইলিং-নোটিং চালু হয়েছে। বেসরকারি দফতরগুলোয়ও পূর্ণভাবে এর প্রচলন ঘটাতে হবে।
যে কোনো পর্যায়ের আদালতের আদেশ, পর্যবেক্ষণ, রায় একজন দিনমজুর থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির প্রয়োজন হতে পারে এবং হয়ও।
কম শিক্ষিত বা লেখাপড়া সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই, ইংরেজিতে লেখা আদেশ পড়ে বোঝা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাছে দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই আদালতের সব ধরনের আদেশ বাংলা ভাষায় লেখার বিষয়টি মহামান্য আদালত সদয় বিবেচনায় রাখতে পারেন।
বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোনসহ বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তির সব বিল বাংলায় রূপান্তর হয়নি। হালে সংযোজিত প্রি-পেইড বিদ্যুৎ মিটারে একটিও সংখ্যা ও শব্দ বাংলায় লেখা নেই। সেবাপ্রাপ্তির সব বিল ও কাগজপত্র অবশ্যই বাংলায় প্রস্তুত করতে হবে।
ইংরেজি পড়তে না জানা লোককেও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। কিন্তু ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম বাংলায় লেখা হয় না। প্যাথলোজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট বাংলায় প্রণয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। আমরা তো ইংরেজি টার্মগুলো বাংলা অক্ষরে লেখার প্রচলন ঘটাতে পারি।
বিভিন্ন বিদেশি ভাষার যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গেছে এবং সেসবের বাংলা প্রতিশব্দ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য সেগুলো বাংলা করার দরকার নেই। কিন্তু জোর করে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ছোট্ট এ ভূখণ্ডে আমরা যদি বাংলা চর্চা ও প্রমিত বাংলা অনুসরণ করতে না পারি, ভাষাকে যদি ক্ষতবিক্ষত করতেই থাকি, তাহলে কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করব?
আরেকটি বিষয় জরুরি ফয়সালার দাবি রাখে। সর্বস্তরে বাংলা চর্চার এ প্রক্রিয়ায় ইংরেজি ভাষার প্রবেশাধিকার ও অবস্থান কতটুকু থাকবে? আমরা দেশের সার্বিক উত্তরণের একটি ধাপ অতিক্রম করছি। বিদেশে জনবল প্রেরণ করা হচ্ছে, লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে অসংখ্য বিদেশি আমাদের এখানে আসছে। তারা বাংলা জানে না। আর আমাদের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ইংরেজিতে অভ্যস্ততা নেই।
ফলে বিদেশিদের সঙ্গে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় কোথাও না কোথাও কিছুটা হলেও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি উত্তরণে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ‘গ্লোবাল লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’ ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসাটা সময়ের দাবি বলে মনে হয়।
বাংলা ভাষাকে প্রভাব বিস্তারকারী, সদা প্রসারমান এবং অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে কার্যকর ভাষায় পরিণত করতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন, মূল্যমান-উত্তীর্ণ সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি শিল্প-প্রযুক্তি ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটাতে হবে।
শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে চালকের আসনে উপবিষ্ট হতে হবে। উন্নত সেবাসম্পন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের জনগণের আস্থা অর্জন ও তাদের বাংলাদেশমুখী করতে হবে।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ, যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগকারী, পর্যটকদের মনোযোগের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করতে হবে। এ দেশে যত বেশি বিদেশিদের আনাগোনা বাড়বে, আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা বিশ্ববাসীর কাছে তত বেশি পরিচিত ও আদরণীয় হয়ে উঠবে। বাংলা ভাষা তখন আপনাআপনি বিশ্বভাষায় পরিণত হবে।