দেবাশীস মূখার্জী
সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর সনাতন ধর্ম-কে বিকৃত করে, আজ কোন পর্যায়ে নামানো হয়েছে। গণতন্ত্র, নারী-পুরুষ সমান অধিকার, বিবাহবহির্ভূত শিশুর পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা,পশু অধিকার,পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি আধুনিক মানবিক মূল্যবোধ সমূহের উৎস পবিত্র ‘বেদ-জ্ঞান’।
অথচ কতগুলো অন্ধ-বিশ্বাস,কুসংস্কার , ভেদ-বিদ্বেষ,অস্পৃশ্যতা ― সমস্ত সত্য আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে জবালার পুত্র সত্যকাম-এর ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের কাহিনী তুলে ধরছি ―
সমাজে এ কথা বহুল প্রচলিত যে – ব্রাহ্মণ বংশে জন্মালেই কেউ ব্রাহ্মণ হয় না ; তার জন্য ব্রহ্মণত্ব অর্জন করতে হয়। গলায় উপবীত নয় ; প্রকৃত ব্রাহ্মণের পরিচয় হলো ব্রহ্মজ্ঞানের সঙ্গে সম্যক পরিচয়। এই উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করেছেন দেহপসারিণী-পুত্র ‘সত্যকাম’।
সত্যকামের মা ছিলেন জবালা। জবালার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কোথাও তিনি দেহ পসারিণী ; কোথাও তিনি সামান্যা দাসী। যৌবনে তিনি বিভিন্ন পুরুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন
এবং একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। বিগত যৌবনে এই মহান পুত্র সত্যকাম-কে নিয়ে একাই থাকতেন জবালা।
মেধাবী ও তীক্ষ্ণধী সত্যকামের ইচ্ছে হল‚ শাস্ত্র পাঠ করবেন | বালক সত্যকাম মহাঋষি গৌতমের নিকট গিয়ে শিষ্য হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করলেন| মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন‚ “বৎস তোমার পিতৃপরিচয় কী ?”
অবোধ বালক সত্যকাম বললেন,”আমি তো পিতার নাম জানি না‚ হে মহাঋষি।”
“বেশ। তুমি তোমার জননীর কাছে গিয়ে জেনে এসো তোমার পিতৃ-পরিচয়।”
সত্যকাম ফিরে এসে জবালার কাছে জানতে চাইলেন, কে তার জন্মদাতা ?
জবালা বললেন‚ “পুত্র‚ যৌবনে আমি বহু পুরুষের সংস্পর্শে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই‚ আমি নিজেই জানি না কে তোমার পিতা ; কার ঔরসে তোমার জন্ম।
সেই উত্তর নিয়েই ঋষি গৌতমের তপোবনে আবার গেলেন বালক সত্যকাম। বললেন,”জবালার পুত্র আমি, নাম সত্যকাম। হে মহা ঋষি,এই আমার নাম-গোত্র-পরিচয়। কারণ,আমার মাতা বলেছেন‚ তিনি এককালে বহু বহুপুরুষগামী ছিলেন ; তাই জানেন না, আমার পিতার নাম।”
স্তম্ভিত মহর্ষি গৌতম। এতটুকু বালকের মুখে এতবড় সাহসী-রূঢ়-সত্যবচন! নিজেকে দেহ পসারিণীর পুত্র বলতে, এতটুকু সঙ্কুচিত নয় এই বালক। এতটাই সত্যবাদী সে! সত্যকামের নির্ভীক-সত্যবাদিতায় মুগ্ধ-বাকরুদ্ধ মহর্ষি গৌতম।
বললেন‚ “হে বালক‚ তোমার গুণে আমি মুগ্ধ। ব্রাহ্মণের সবথেকে বড় গুণ ‘সত্যবাদিতা’। তুমি সেই অনন্য গুণের অধিকারী,পুত্র। তুমি ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ – লাভ করবে না, তো কে করবে! তুমি আমার শিষ্যত্ব গ্রহণের উপযুক্ত। আমি তোমার আচার্য হব।
এভাবেই নিজের নামের মর্যাদা রক্ষা করেছিল দাসী-পুত্র সত্যকাম ; কিংবা দেহপসারিণী-তনয় সত্যকাম। নিজের মাতৃপরিচয় অবলম্বন করে, যাঁর দর্পিত পদার্পণ – ব্রাহ্মণ সমাজে।
শিষ্য সত্যকাম কেমন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন – তার পরীক্ষা নিতে মহর্ষি গৌতম, তাঁকে পাঠালেন দূর দেশে। সঙ্গে দিলেন ৪০০ গাভী। বললেন‚ ৪০০ থেকে যখন ১০০০ গাভী হবে, তখনি তুমি প্রত্যাবর্তন করবে।
আচার্যের আদেশ পালন করতে গেলেন সত্যকাম। এই সময়ে তপস্যায় তিনি ‘ব্রহ্মত্ব’ – লাভ করেন। এক ষণ্ড এসে তাঁকে বলে‚ “হে সত্যকাম‚ পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ‚ এই চারদিকই হল ‘ব্রহ্ম’।”
এরপর এলেন অগ্নিদেব। বললেন‚ পৃথিবী‚ মহাশূন্য‚ স্বর্গ এবং মহাসমুদ্র‚ এই চার হল ‘ব্রহ্মজ্ঞান’।”
এরপর এল এক রাজহংস। বলল‚ হে ভদ্র সত্যকাম‚ অগ্নি‚ চন্দ্র‚ সূর্য এবং বজ্রপাত‚ এই চার হলো ‘পরম ব্রহ্ম’।”
সবার শেষে এল এক, পানকৌড়ি। বলল‚ “প্রাণ‚আঁখি‚ কর্ণ এবং মন ― সংসারে এই চারটি হল ‘ব্রহ্ম’।”
ক্রমে ক্রমে সত্যকাম ‘পরম-সত্য’ – উপলব্ধি করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর নিজস্ব অন্তর্কণ্ঠ-ই চারবার কথা বলেছে। এটা একান্ত তাঁর-ই উপলব্ধ জ্ঞান। ফিরে এলেন, আচার্য গৌতমের কাছে – সঙ্গে এক সহস্র গাভী।
মহর্ষি প্রশ্ন করলেন শিষ্যকে ; জানতে চাইলেন ‘ব্রহ্মত্ব’ নিয়ে। সত্যকাম উত্তর দিলেন‚ ‘পরম ব্রহ্ম’ – সব শক্তির উৎস। তিনি সর্বব্যাপী -সর্বশক্তিমান। তাঁর কোন আদি-অন্ত নেই। তিনি-ই পরম জ্ঞান ; সব আলোর আলো। তিনি-ই সমস্ত কিছুর উৎস।
সত্যকামের উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন, মহর্ষি গৌতম। বললেন‚ তুমি সঠিক পথের দিশা দেখতে পেয়েছ,পুত্র। তোমার উপলব্ধি ‘ধ্রুব’। ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ না করেও তুমি ‘পরম ব্রাহ্মণ’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী সৃষ্টি ‘ব্রাহ্মণ’-কবিতাটি তুলে ধরছি ―
ব্রাহ্মণ
ছান্দোগ্যোপনিষৎ । ৪ প্রপাঠক । ৪ অধ্যায়
অন্ধকারে বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে
অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য; আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রম-মাঝে ঋষিপুত্রগণ
মস্তকে সমিধ্ভার করি আহরণ
বনান্তর হতে; ফিরায়ে এনেছে ডাকি
তপোবনগোষ্ঠগৃহে স্নিগ্ধশান্ত-আঁখি
শ্রান্ত হোমধেনুগণে; করি সমাপন
সন্ধ্যাস্নান সবি মিলি লয়েছে আসন
গুরু গৌতমেরে ঘিরি কুটিরপ্রাঙ্গণে
হোমাগ্নি-আলোকে। শূন্য অনন্ত গগনে
ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি; নক্ষত্রমণ্ডলী
সারি সারি বসিয়াছে শুষ্ক কুতূহলী
নিঃশব্দ শিষ্যের মতো। নিভৃত আশ্রম
উঠিল চকিত হয়ে; মহর্ষি গৌতম
কহিলেন, “বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি
করো অবধান।’
হেনকালে অর্ঘ্য বহি
করপুট ভরি’ পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দী ফলফুলদলে
ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,
“ভগবন্, ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছে দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী,
সত্যকাম নাম মোর।’
শুনি স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,
“কুশল হউক সৌম্য। গোত্র কী তোমার?
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।’
বালক কহিলা ধীরে,
“ভগবন্, গোত্র নাহি জানি। জননীরে
শুধায়ে আসিব কল্য, করো অনুমতি
এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি সত্যকাম ঘন-অন্ধকার
বনবীথি দিয়া, পদব্রজে হয়ে পার
ক্ষীন স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী; বালুতীরে
সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে
করিলা প্রবেশ।
ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি; হেরি তারে বক্ষে টানি
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণকুশল। শুধাইলা সত্যকাম,
“কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,