স্বীকৃতি।
কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী এক সময় বলতেন, কংগ্রেসে যোগ দেওয়া সহজ। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসাও সহজ। বেরিয়ে গিয়ে আবার প্রবেশ করাও সহজ। কঠিন হল কংগ্রেসে টিঁকে থাকা। টিঁকে থাকা কেন কঠিন, তার অনেকগুলো কারন আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল স্বীকৃতি না পাওয়া। উপযুক্ত মর্যাদা না পাওয়া। অধীর রঞ্জন চৌধুরী (Adhir Ranjan Chowdhury) অবশ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। তবে আজকের স্বীকৃতির পিছনে তাঁর দীর্ঘ দিনের টিঁকে থাকার লড়াইটাও ছিল কঠিন।
কংগ্রেসের অনেক নেতা নেহাতই বড় কোনও নেতার সহচর হয়ে নিজের রাজনৈতিক
জীবন কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁর ভিতরের প্রভূত রাজনৈতিক সম্ভাবনা চাপা
পড়ে থাকে তিনি যাঁর অনুচর তাঁর ব্যক্তিত্বের চাপে। রাজ্য কংগ্রেসেই এমন
উদাহরণ আছে। আবার চিরকাল অমুকদার ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকা, কোনও
স্বীকৃতি না পাওয়া কোনও নেতা বা নেত্রী তৃণমূলে যোগ দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক
যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সংসদে এবং বিধানসভায় এই উদাহরণও রয়েছে।
ধান ভানতে শিবের গীত একটু গাইতে হল। বেশ কিছুদিন ধরে রাজ্য রাজনীতির
অন্দরমহলে উপরিউক্ত কথাগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে কংগ্রেসের চিরশত্রু
বিজেপিও কি কংগ্রেসের এই দোষে দুষ্ট?
প্রশ্ন ওঠার কারন একটাই। গত ৩ বছর ধরে বিজেপি মুকুল রায়ের (Mukul Roy)
অগ্নিপরীক্ষা নিচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত
থাকে। কিংবা উল্টোটাও সত্যি, কর্তব্যের মধ্যে অধিকার। বিজেপি ও মুকুল রায়ের
সম্পর্কটা এই ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করছে। মুকুলের কর্তব্য আছে, অধিকার আছে
কি? শেষ তিন বছর ধরে মুকুল তাঁর রাজনৈতিক মেধা তৃণমূলের বিপক্ষে কাজে
লাগিয়েছেন, কিন্তু তাঁর নতুন এই দলের আভ্যন্তরীণ বিরোধে কাজ করেনি
মুকুল-মেধা, বা তিনি কাজে লাগান নি। রাজ্য বিজেপিকে শক্তিশালী করে তৃণমূলের
বিরুদ্ধে তিনি লড়াইতে নামবেন নাকি দলের পুরনোদের ‘ইগো স্যাটিসফাই’ করবেন,
কোনটা হওয়া উচিত তাঁর ফার্স্ট প্রেফারেন্স? এই ভাবনাও মুকুলকে ভাবতে হয়েছে
বারবার।
উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ১৮টা আসন পেয়েছিল বিজেপি। রাজ্য রাজনীতির হাঁড়ির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা বলেছিলেন, বিজেপি যদি সাত থেকে আটটা আসনের মধ্যে আটকে থেকে যেত, তাহলে স্পষ্ট হত এই নির্বাচনে মুকুলের কোনও ভূমিকাই কাজে লাগেনি। কিন্তু আঠারোটা আসনে জয় মুকুল ম্যাজিক ছাড়া সম্ভব নয়। তবে বিজেপির তরফ থেকে প্রকাশ্যে মুকুলকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং সাফল্যের রেকর্ড জমা পড়েছে রাজ্য সভাপতির খাতাতেই (সেটাই স্বাভাবিক)।
তাঁর আমলে বিজেপি আঠারোটা সাংসদ পেয়েছে, এই রেকর্ডও তাঁকে আরও একবার সভাপতিত্বের দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
রবিবার কলকাতার শহীদ মিনারে বিজেপির সভায় অমিত বচনে মিলল সেই স্বীকৃতি। যে
সভা থেকে অমিত শাহ (Amit Shah) কার্যত একুশের লড়াই শুরু করে দিলেন, সেই
সভায় অমিত শাহ যা বললেন, সেই কথা শোনার জন্য হয়ত মুকুলের কানও আজ প্রস্তুত
ছিল না।
রবিবার শহীদ মিনারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই উনিশের সাফল্যের কৃতীত্ব মুকুল রায়কেই দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এদিন অমিত শাহ মঞ্চে আসার কিছুক্ষণ আগেই নিজের বক্তৃতা শেষ করে দেন মুকুল। পরে বক্তৃতা করতে উঠে রাজ্যের একের পর এক নেতাদের নাম করছিলেন প্রাক্তন সভাপতি। প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর নাম করার সময় অমিত শাহ বলেন, “বাংলা থেকে ১৮ টি আসন জেতাতে যিনি আগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি হলেন নির্বাচন কমিটির আহবায়ক মুকুল রায়। তাঁকে আমি ধন্যবাদ জানাই।”
এরপর বারংবার এই আঠারোটি আসনের গুরুত্ব বলেছেন অমিত। বলেছেন এই আঠারো বিজেপিকে প্রথমবার সংসদে ৩০০ আসনের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বিজেপি-তে যোগ দেন মুকুল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তাঁকে নির্বাচন কমিটির আহবায়ক করে বিজেপি।
ফলাফল মেলে হাতেনাতে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮টি আসনে জেতে বিজেপি।
প্রকাশ্যে স্বীকৃতি পেতে মুকুলের হয়ত একটু বেশি সময় লাগল। তবে ব্যক্তি মুকুল না হোক, তৃণমূলের বিরুদ্ধে অস্ত্র মুকুলকেও যদি আজ স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অমিত তাহলে এটুকু আপাতত বলা যায় যে, বিজেপি-টিএমসি সমঝোতার সে তত্ত্ব বাম-কংগ্রেস ছড়াচ্ছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি।
আর মুকুল?
বিজেপির কাছে মুকুল প্রথমে ব্যক্তি হোন বা অস্ত্র, দুটি ক্ষেত্রেই কার্যকরী ফল দেবার জন্য পরিসর লাগে। ইংরেজিতে যাকে বলে স্পেস।
বিজেপির ছোট থেকে বড় সব নেতা, এমনকি মোদি-শাহের সঙ্গেও মুকুলের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। মমতার বিরুদ্ধে মুকুলের লড়াইটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত লড়াইও বটে। বাকিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই এই লড়াই নেহাতই রাজনৈতিক।
এদিন শহীদ মিনারে একুশ-যুদ্ধের গান চড়া সুরে বেঁধেছেন অমিত।
মমতার বিরুদ্ধে শেষ দশ ওভারের খেলায় ক্রিকেটার মুকুলকে ঠিক কোন ভূমিকায় চাইছেন অমিত? সে দিকে এখন অবশ্যই নজর থাকবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।