সুমন হালদার
বাংলাভাষার উদ্ভব থেকে আজ পর্য্যন্ত সময়কাল অব্দি শতাব্দীর পর শতাব্দী অনেক
ভাষার প্রভাব এই ভাষার উপর পড়েছে তবু বাংলা ভাষা নিজের পায়ের উপরেই
দাঁড়িয়ে আছে আজও! ফলে একথা বলাই যেতে পারে বাংলাভাষা সহজে বিলুপ্ত হয়ে যাবে
না! সত্যি! কিন্তু তবু এই ভাষার ভবিষ্যত কতটা উজ্জ্বল? অনেকেই হয়তো এই
প্রশ্নকে অপ্রাসঙ্গিগ বলে হেসে উড়িয়ে দেবেন! কিন্তু বর্তমান আর্থ সামাজিক
রাজনৈতিক পরিস্থিতির রূপরেখায় এই প্রসঙ্গটি কতটা প্রসঙ্গিক সেটা বুঝে নেবার
সময় এসেছে আমাদের!
যে কোনো ভাষার গতি প্রকৃতি নির্ভর করে মূলত সেই দেশের দেশবাসির মতিগতির উপর!
সেই দেশের আবহমান ঐতিহ্যের সাথে বিশ্বের সমকালীন আধুনিকতার নিরন্তর দেওয়া
নেওয়ার উপর! বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থাটা এবারে একটু ভালো করে দেখা যাক!
বাংলার দূর্ভাগ্য আজ ছয় দশকের উপর বাঙলাভাষী অঞ্চলটি চারটি ভাগে বিভক্ত!
স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম এর বরাক
উপত্যাকা! বাংলাদেশের মুখ্য সরকারী ভাষা অবশ্যই বাংলা! সেখানে বাংলাভাষা
জাতীয় গৌরবে অধিষ্ঠিত! সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে! কিন্তু ভারতের অংশ হিসেবে
বাকি তিনটি অঞ্চলে বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থানটি ঠিক কি! আগে সেটি দেখা যাক!
ভারতবর্ষের হিন্দীবলয়ের চাপে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দীভাষার ব্যাপক প্রসার
এই তিন অঞ্চলের উপরেই প্রবল প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ক্রামান্বয়ে! সমাজের
সর্বস্তরেই হিন্দী আদৃত! এবং সম্মানিত!
এই অঞ্চল তিনটিতে হিন্দীভাষার প্রভাব এতটা সমাদৃত হওয়ার কয়েকটি কারণ
বিদ্যমান!
প্রথমতঃ জাতি হিসেবে বাঙালির নিজস্ব একটি প্রকৃতিই হলো, আমরা অর্থনৈতিক দিক
থেকে বেশি ক্ষমতাধর বিত্তশালী ও ধনৈশ্বর্য্যে উন্নত জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির
প্রতি খুব সহজেই অনুরক্ত হয়ে পড়ি!
বাঙালির ইতিহাসে বরাবরই একথা প্রমাণিত সত্য! এবং আমরা সবসময়ই রাজভাষার
পৃষ্ঠপোষোক! সেই কারণে বাংলাভাষায় এত বিদেশী শব্দের ছড়াছড়ি! আজকে দিল্লীর
কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রাজভাষা হিন্দী তাই আমাদের হৃদয়ের এত কাছে স্থান
পেয়েছে! এরই সূত্র ধরে হিন্দুস্থানী সংস্কৃতিকে আমরা আপনার বলে গ্রহণ করেছি
সাদরে! বাংলার প্রেক্ষিতে হিন্দী যে ভিনদেশী ভাষা সে আমরা ভুলেছি!
দ্বিতীয়তঃ এই ধরণের মানসিকতার সূত্র ধরেই অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ব্যাপী
সারা বাংলার সমস্ত অঞ্চলেই বোম্বাইয়ের হিন্দী সিনেমা এত জনপ্রিয়! প্রায়
প্রতিটি শহরে নগরে মফঃস্বলে নব্বই শতাংশ হলেই হিন্দী সিনেমা চলে রমরমিয়ে! এই
চিত্র চলে আসছে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে! হিন্দী সিনেমার এই বিপুল
জনপ্রিয়তার হাত ধরেই সারা বাংলার সকল অঞ্চলেই হিন্দী এখন বাঙালির মুখের ভাষা!
এর সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দীভাষী টিভিগুলির বিপুল জনপ্রিয়তো! বহু বাঙালিই
বাংলা ছেড়ে সারাদিন হিন্দী খবর শোনেন! টিভিতে বাংলা অনুষ্ঠানের নাম শুনলে নাক
সিঁটকান অনেকেই! এবং হিন্দী গান, আপামর বাঙালির মননে অন্তরের পরমাত্মীয় হয়ে
উঠেছে এই বাংলায়!
তৃতীয়তঃ বৃটিশ আমল থেকেই শিল্পায়ণের হাত ধরে কলকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্যের
প্রসারের সাথে প্রচুর পরিমাণে হিন্দুস্থানী বাংলায় চলে আসেন স্থায়ী ভাবে!
এবং এই প্রবণতা এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে! পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহরেই প্রচুর
পরিমাণে অবাঙালি, এখন স্থায়ী অধিবাসী হয়ে গিয়েছেন! ফলে হিন্দীভাষী স্কুল
কলেজের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান! এবং পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসাবাণিজ্য বহুকাল থেকেই
তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন! ফলে বাঙালী চাকুরী থেকে ব্যবসায় শিল্পের শ্রমিক থেকে
প্রশাসনে সর্বত্রই হিন্দীভাষীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দীকেই
ব্যবহার করে সানন্দে! ফলে এরাজ্যের সর্বত্র হিন্দীই এখন বাংলার সহদোর হয়ে
উঠেছে!
তিন শতকের বৃটিশ শাসনের ফলে সুস্থ সুন্দর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত জীবনযাপন ও
জীবিকা নির্বাহের সাথে ইংরেজী ভাষাটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে! ইংরেজী জানা
বাঙালি আর ইংরেজী না জানা বাঙালির মধ্যে সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজন
তৈরী হয়েছে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে! ফলে সমাজে উন্নততর জীবন যাপনের প্রধানতম
শর্তই হলো ভালোভাবে ইংরেজী শিক্ষা!
যে কারণে সারা বাংলার সর্বত্রই ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনোর জন্য এত স্কুল কলেজ
গড়ে উঠেছে! এবং যা অত্যন্ত ব্যায় বহুল! যার ফলে আর একবার বংশ পরম্পরায়
অর্থনৈতিক শ্রেণী সৃষ্টির ধারা চালু হয়ে গেল!
যেখানে ইংরেজী ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত আজও গড়ে ওঠে নি, সেখানে এটাই
নিদারুণ বাস্তব!
কোনো ভাষা তখনই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই
ভাষা স্বদেশবাসীর জীবনজীবিকায় নির্ভরতা দেয় এবং সেই ভাষায় সৃষ্টি হওয়া
উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি স্বদেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিত করে বিশ্বমানবকেও
পুষ্টি যোগাতে সক্ষম হয়!
দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার অবদান প্রথম দুইটির ক্ষেত্রে একেবারে শূন্য! এবং
শেষেরটির ক্ষেত্রে আমরা যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব
করি, বিশ্ব সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি আজও ততটা বিখ্যাত
তো নয়ই বরং বেশ পিছনের সারিতেই তার অবস্থান! ফলে এই বাস্তব পরিস্থিতিতে
দাঁড়িয়ে
আজকের বাংলাভাষা! বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিশেষ প্রসঙ্গিক নয় আর!
অর্থাৎ বর্তমানে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে বঙ্গ জীবনে ইংরেজী ও
হিন্দীর ব্যাপক প্রয়োগ ও নিরন্তর ব্যবহারে দৈন্দিন বেঁচে থাকার কাজ থেকে জীবন
গড়ে তোলা ও উন্নততর জীবন যাপনের জন্য বাংলা ভাষার কোনই উপযোগিতা অবশিষ্ট নেই
আর! অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের দুই প্রান্তে হয় হিন্দী নয় ইংরেজী জানতেই হবে
জীবিকা নির্বাহের জন্য!
উচ্চশিক্ষা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা; চিকিৎসা বিজ্ঞান ও সুস্বাস্থ পরিসেবা; আইন
আদালত থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম সবই ইংরেজী ভাষা নির্ভর!
তাহলে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করার উপায় নেই! উপায় নেই জ্ঞানবিজ্ঞান
চর্চার কোনো কার্যকরি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার! কারিগ