আক্ষরিক অর্থেই আজ সেরকমটাই মালুম হল বটে ! মাস দু’য়েকও হয় নি ফুরফুরা মসজিদের ধর্মগুরু ত্বহা সিদ্দীকির ভাতিজা আব্বাসউদ্দিন সিদ্দীকি ‘ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেই জীবনের প্রথম ব্রিগেড সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সুযোগটিকে যেভাবে কাজে লাগালেন তা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম–বামপন্থীদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার মলাটটিকে ফালা ফালা করে দিয়ে সুস্পষ্ট কিছু বার্তা তিনি দিয়ে রাখলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন–প্রয়োজনে আমার রক্ত দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করবো–ভাবা যায় ! তিনি প্রকারান্তরে জানালেন যে, তিনি একটি পরাধীন দেশের নাগরিক। বামনেতারা তাঁর বক্তব্যকে অনুমোদন করলেন–কোনোরকম প্রতিবাদের ধারে কাছে গেলেন না। আব্বাসউদ্দিনের আজকের কণ্ঠস্বরে কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হল বলেই আমার মনে হয়েছে।
একদিকে ত্বহা সিদ্দীকি নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করছেন –তাঁর পাশে থাকার অঙ্গীকার করছেন–অন্যদিকে তাঁর ভাতিজা মমতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বামজোটের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার সেন্টিমেন্টাল নাটক করছেন। চাচা-ভাতিজা দু’জনেই খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছিলেন একদিকে আসাউদ্দিনের মিম–অন্যদিকে বামজোট সংখ্যালঘু ভোটে বড় রকমের থাবা বসাতে চলেছে। যদি তেমনটা হয় তাহলে বিজেপিকে কিছুতেই রোখা যাবে না। সুতরাং সংখ্যালঘু ভোট যাতে মিম বা বামজোটের বাক্সে গিয়ে বিজেপিকে সরাসরি সুবিধেজনক জায়গায় নিয়ে না যেতে পারে তার জন্যে একটা সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতেই হবে। সেই সুচিন্তিত পদক্ষেপটি হলো সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগই একদিকে টেনে আনার চেষ্টা করা। তার জন্যে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে বাম জোটের সমর্থনে সেকুলার ফ্রন্টের প্রার্থী দিয়ে আসনগুলিকে ধরে রাখা জরুরি। বামেদেরও–আশ্চর্য্যজনক ভাবে হলেও মনে হয়েছে–ভাইজানের এই রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার সানাই বেজে উঠবে। এমন ধারণা যাকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করে তুলেছে তিনি হলেন সিপিএমের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ইন্টেলেকচুয়াল কমরেড মহম্মদ সেলিম। ব্রিগেডের মঞ্চে ভাইজান উপস্থিত হওয়া মাত্র তাঁর যে উচ্ছ্বাস আমরা দেখলাম তার একটা রীতিমতো অস্বস্তিকর প্রতিক্রিয়াও দেখতে হলো আমাদের। বিরক্ত অধীরবাবুকে কোনরকমে শান্ত করতে এগিয়ে আসতে হলো বিমান বসুকে। সূর্যকান্ত মিশ্র এগিয়ে গিয়ে ভাইজানকে যেভাবে আলিঙ্গন করলেন যা দেখে মনে হল কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইকে বুকের মধ্যে ফিরে পেলেন ! সূর্যবাবুর আজকের এই অনুভূতি ভোটের ফল প্রকাশের পর থাকবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না বটে–তবে পাঁচ-সাতটা আসন দখল করে চাচার হাত ধরে ভাইজান যদি কালীঘাটে চলে যান তাহলে আমি অন্ততঃ অবাক হব না–সত্যি বলতে কি এরকম একটা পূর্বলিখিত স্ক্রিপ্টের ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য হিসেবে সেরকমটাই দেখা যেতে পারে বলে আমার কিন্তু খুব স্পষ্টভাবেই মনে হচ্ছে। মমতাকে ব্রিগেড থেকে কঠোর ভাষায় হুমকি দেওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক আক্রমণের যে তীব্রতা ভাইজানের বক্তব্যের মধ্যে দেখা গেল তা ফুরফুরা শরিফের ধর্মগুরু ত্বহা সিদ্দীকির ভাতিজার দিক থেকে প্রত্যক্ষ করতে হলে মনে হতেই পারে–বেশ খানিকটা বাড়াবাড়িই হয়ে গেল।
গতকালই আমি লিখেছিলাম–ব্রিগেডে ভালই ভিড় হবে। ভাইজানের সমর্থকের সংখ্যাও আজ উল্লেখযোগ্য ছিল। তাদের হর্ষোল্লাসের যাবতীয় শব্দ ব্রিগেডের মাইক্রোফোনগুলো খুব সহজেই ক্যাচ করে মাঠময় ছড়িয়ে দিতেও পারছিল। ভাইজানের মঞ্চে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই–তাঁর ভাষণের মাঝে মাঝে, বিশেষ করে তিনি যখন কংগ্রেসের দিকে কঠোর বার্তা ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন–তাঁর নিজস্ব শ্লোগান দিচ্ছিলেন তখন মাঠ জুড়ে যে চিৎকার ও হর্ষোল্লাস শোনা গেল তা আর কোনো নেতার ক্ষেত্রেই শোনা যায় নি। প্রথম ব্রিগেড সমাবেশেই সদ্যগঠিত একটি রাজনৈতিক দলের সুপ্রিমো হিসেবে তিনি যেন হাসতে হাসতেই নিজেকে স্টার বানিয়ে ফেললেন ! একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট হলো–রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশই তৃণমূলের হাতছাড়া হতে চলেছে (পরে ভাইজানের সমর্থনের ঘুরপথে ফিরে আসতেও পারে)–পাশাপাশি অমুসলিম ভোটারদের মধ্যে যারা ভাবছিলেন বামজোটের পাশে দাঁড়াবেন তাদের সিংহভাগই কিন্তু বেজায় অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। বলা ভাল বেশ খানিকটা আশঙ্কা তৈরি হলো তাদের মধ্যে। এই আশঙ্কাই না তাদের বিজেপি’র ভোটবাক্সের দিকে ঠেলে দেয়। দিলে আমি অবাক হবো না। সে সম্ভাবনাটা কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়। মুখে তিনি যতই নিজেকে ধর্মনিরেপক্ষ দাবি করুন না কেন তাঁর জোরালো ভাষণের মধ্যে আজহার মাসুদের কণ্ঠস্বরই যেন অনেকটা শোনা গেল ! কংগ্রেস–বলা ভাল অধীরবাবুও ভাইজানের এই বিস্ময়কর উত্তজনার মধ্যে বিশেষ কিছু গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পান নি–আর সেই কারণেই ভাইজানের ব্যাপারে রীতিমতো মেপে পা ফেলার কথাই তাঁকে ভাবতে হচ্ছে। ভেসে ওঠার মরিয়া তাগিদে ভাইজানকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরার ফল আখেরে বামেদের পক্ষে কতটা মঙ্গলদায়ক হতে চলেছে সেটা ফলাফল প্রকাশের পর বোঝা যাবে।
আমি কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই জানিয়ে রাখছি–ভাইজান সহ বামজোটের পক্ষে এই কেমেস্ট্রি খুব ভাল ফল দেবে না। ভাইজান সদ্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে পাঁচ-সাতটা আসন যদি দখল করে নিতে পারেন (সম্ভাবনা থাকছে) তাহলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৃণমূল এবং লক্ষ্যণীয়ভাবে লাভবান হবে বিজেপি। সংখ্যালঘু ভোট বামজোট এবং ভাইজান যতটা ভাঙাতে পারবেন ততটাই লাভ হবে বিজেপি’র। উপঢৌকন হিসেবে ভাইজানের সৌজন্যে বেশ কিছু হিন্দুভোট বিভাজনের রাজনীতিতে ডুবে যাওয়া রাজ্যে বিজেপি পেয়ে যেতেই পারে। এর মধ্যে কোনো দুর্বোধ্য অঙ্ক নেই !!