বিধানসভা নির্বাচন লোকসভা নির্বাচনের মতো সহজ সমীক্ষার নির্বাচন নয়। লোকসভার আসন সংখ্যা মাত্র ৪২ এবং বিধানসভার আসন সংখ্যা ২৯৪ এবং এই দুই নির্বাচনের চরিত্রও একরকম নয়। বহু জটিলতা রয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে। অন্যান্য ব্যক্তি বা সমীক্ষক দল বাঁধাধরা কিছু প্রশ্নমালা দু’দশ হাজার লোকের সামনে রেখে উত্তর সংগ্রহ করেন এবং সেই উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে একেক জন একেক রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছুনোর চেষ্টা করেন। চ্যানেলগুলো অবশ্য দাবি করে তারা যে সব বিশেষজ্ঞ সমীক্ষকদের দিয়ে সমীক্ষা করিয়ে থাকে তাদের কোনোভাবেই প্রভাবিত করা হয় না। এইসব দাবি যে নিছকই বিধিবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিকতা ছাড়া আর কিছু নয় তা সমীক্ষার ফলাফলের মধ্যেই খুব স্পষ্ট করেই প্রতিফলিত হয়। এখনও পর্যন্ত জনমতামত সংগ্রহের জন্যে যে সব কোয়েশ্চেন-কার্ড আমি চ্যানেলগুলিতে দেখেছি তার মধ্যে রাজ্যের ২২ থেকে ৩০-৩২ বছরের তরুণ-তরুণীরা কোন্ দলের পক্ষে নিজেদের সমর্থন দেওয়ার কথা ভাবছে বা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তারা কি কি প্রত্যাশা করছে–এ ধরণের গুরুতর প্রশ্ন দেখি নি। সাধারণ ভাবে বেকার ছেলেমেয়েরা কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির কথা বলছে–এমনটাই দেখানো হয়। কিন্তু ২২ থেকে ৩২ বছরের ভোটারদের রাগ-অনুরাগ কিন্তু মারাত্মক ফ্যাক্টার হয়ে ওঠে নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে। আমি কিন্তু এই বিষয়টার ওপর জোর দিয়ে থাকি। কারণ, সরকার থাকবে কি থাকবে না–পরিবর্তন হবে কি হবে না তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে এই এজগ্রুপের ওপরেই। আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি এই এজগ্রুপের ভোটারদের সিংহভাগই রীতিমতো হতাশ ও বিরক্তির চরমতম প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে পরিবর্তনের কথাই ভাবছে। বন্ধ শিল্পের দরজা খোলে নি, নতুন শিল্পের বহু গালগল্প হয়েছে কিন্তু কিছুই হয নি। গত দশ বছরে এসএসসি নিয়মিত হচ্ছে না, পিএসসি যদিও বা অল্পস্বল্প হচ্ছে তার মধ্যেও ব্যাপক দুর্নীতি ঢুকে গেছে। স্থায়ী শূন্যপদে দু’চার হাজার টাকার ভাতার (অনেকেই ভিক্ষে বলে থাকেন) বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করা হচ্ছে। হাজার রকমের শ্রীযুক্ত অনুদান (অনেকেই ভিক্ষে বলে থাকেন), ৫০০ থেকে হাজার-দু’হাজার মাসিক ভাতার ঘোষণা করে যুবসমাজকে কর্মহীন পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ভাতা বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সরকারি বা সরকার পোষিত সংস্থাগুলোতে বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। রাজ্য থেকে হাজার হাজার শ্রমিক অন্যরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। রাজ্যে চটকদার সব শ্রী-সবুজসাথী-কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর বাজনা বাজানো হচ্ছে উচ্চনিনাদে–কিন্তু স্থায়ী কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থাই করা হচ্ছে না–অদূর ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিটি পদক্ষেপে কেন্দ্রের সঙ্গে ঝগড়া করে বিদ্রোহ করে কিছু করতে পারবে বলে এই এজগ্রুপের ভোটাররা বিশ্বাস করতে পারছে না। ফলে একটা বড়মাপের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে চলেছে এবারের ভোটে। এই বিষয়টা আমার পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছে।
তৃণমূলবিরোধী বিজেপি দলের ডাবল-ইঞ্জিন থিওরি কিন্তু মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। ফলে বিজেপির পক্ষে সম্ভাবনাটা খানিকটা বেড়েও গেছে। এমনিতেই বিজেপি’র দ্রুত বিস্তারে তৃণমূলের ভুলের পর ভুল সিদ্ধান্তই যে দায়ি তা নিয়ে কারুর কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে বহুবার বিশদে আলোচনা করেছি। তৃণমূলের ভুল রাজনীতি, আচমকা পিকে’র উদয় এবং তার কর্পোরেট ভোট কৌশলের স্টান্টসর্বস্ব অর্থহীন চমকের পর চমক, দলের শুদ্ধিকরণের নামে কাটমানি-সিণ্ডিকেট-তোলাবাজি’র অভিযোগে সীলমোহর প্রদান, এক ধাক্কায় ৬৫ জন বিধায়ককে বাতিল করে দিয়ে শতাধিক নতুন প্রার্থীকে টিকিট বন্টন–ইত্যাদির ধামাকায় ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে গেল। একের পর এক দাপুটে নেতা-বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্তরে স্তরে কত যে ঘুণ ধরে গিয়েছিল তার প্রমাণ তুলে ধরলেন। পরিস্থিতি এতটাই বিগড়ে গেল যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমোকে স্বীকার করে নিতে হল শুভেন্দুর দলত্যাগের ঝটকাটা কতটা তীব্র আঘাত হেনেছে। মুখে শুভেন্দুর দলত্যাগকে তুচ্ছ করার চেষ্টা থাকলেও তার বিরুদ্ধেই মুখ্যমন্ত্রীকে প্রার্থী হতে হল নন্দীগ্রামে–এর পরেও শুভেন্দু কোনো ফ্যাক্টরই নয় যারা বলছেন তাদের অসহায়তা কি গোপন থাকতে পারে? শুভেন্দুকে এই সঙ্কটকালে এড়িয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বিরাট গুরুত্ব দিতে বাধ্য হলেন কেন? এর উত্তর নন্দীগ্রামের ভোটারদের কাছেই পাওয়া সম্ভব। প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বের সামনের সারিতে পরিত্যক্ত বিতর্কিত এবং দলের ভাবমূর্তিকে মলিন করা তথাকথিত ‘নেতা’দের কেন তুলে আনা হল–আনার ফলে দলের ভাবমূর্তি আরও কতটা খারাপ হল সেটাও ভেবে দেখা হল কি? মানুষ কিন্তু ভাবছে।
আমি লক্ষ্য করছি–বেশ কিছু সমীক্ষক-বিশ্লেষক দাবি করছেন এবারের নির্বাচনে বামসংযুক্ত মোর্চা বিজেপি’র ভোট কেটে তৃণমূলের সুবিধে করে দেবে। একেবারেই হাস্যকর দাবি হিসেবে উঠে এসেছে আমার পর্যবেক্ষণে। কেউ না বললেও আমি বলেছি–গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বাম-কংগ্রেস থেকে যারা বিজেপি’র পক্ষে চলে গিয়েছিল তাদের সিংহভাগই ফিরে আসার কথা মোটেও ভাবছে না। কারণ, এই মুহূর্তে বাম-কংগ্রেসের কোনো ভবিষ্যৎ-ই নেই। কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা তারা দেখছে বিজেপি’র। ফলে প্রায় নিশ্চিত ভবিষ্যতের পক্ষে না থেকে তারা কেন ফিরে যাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পক্ষে ! বিশেষ করে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক নিজেই যখন বলছেন–বিজেপিকে তৃণমূল সরাতে পারবে না–পারলে বামেরাই পারবে। তাই আগে তৃণমূলকে সরাতে হবে–তৃণমূল সরে গেলেই বিজেপিকে সরাতে বামেদের সমস্যা হবে না।–অর্থাৎ বিজেপি’র ক্ষমতায় আসতে সমস্যা হয় এমনটা বামেরা চাইছে না। তাহলে বিজেপি’র ভোট কেটে বামেরা তৃণমূলের ফের ক্ষমতায় বসার বাপারটা সহজ করে দেবে কেন? বাম সংযুক্ত মোর্চা সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে বিজেপিকে অনেকটাই স্বস্তিতে রাখতে চলেছে। আব্বাস সিদ্দিকী সংখ্যালঘু ভোটের দৌলতেই সদ্য দল গঠন করেও রাজ্যের বিভাজন রাজনীতির পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৪-৫’টি আসন দখলও করতে চলেছে বলেই আমার পর্যবেক্ষণে দেখতে পাচ্ছি। বাম সংযুক্ত মোর্চার আসন সংখ্যা যত বাড়বে ততটাই ক্ষতি হবে তৃণমূলেরই–বিজেপি’র নয়। আমার এই ধারণার সঙ্গে এই মুহূর্তে অনেকেই একমত হবেন না–কিন্তু ফলাফল প্রকাশের পর সহমত হতে অসুবিধে হবে না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
জেলা ধরে ধরে আমি যে ভাবে সম্ভাবনার বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে তৃণমল কংগ্রেস একাধিক জেলায় খাতা খোলার জায়গাতেও থাকছে না। কলকাতার ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যও ধাক্কা খেতে চলেছে। ধাক্কা খেতে চলেছে তাদের গড় হিসেবে চিহ্নিত দুই চব্বিশপরগণাতেও। হাওড়া-হুগলী-নদিয়া-অবিভক্ত মেদিনীপুর সহ সামগ্রিকভাবে গোটা জঙ্গলমহল (বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম) এখন আর ক্ষমতায় ফেরার জন্যে খুব নিশ্চিত নয়। উত্তরবঙ্গেও খুব একটা সুবিধে হবে না মূলতঃ বাম সংযুক্ত মোর্চার ভাগ বসানোর রাজনীতির কারণেই। বাম সংযুক্ত মোর্চা আসন খুব বেশি না পেলেও দু’আড়াই শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূলের বহু নিশ্চিত আসন হাতছাড়া করে দেবে। বেশ কিছু নক্ষত্র পতনের সহায়ক ভূমিকা নেবে বাম সংযুক্ত মোর্চা। উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে বাম সংযুক্ত মোর্চা’র দখলে যেতে পারে ২১-টি আসন এবং আইএসএফ ৪-৫’টি আসন পেতে পারে–অর্থাৎ ২৫-২৬’টির বেশি আসন সংযুক্ত মোর্চা না পেলেও তারা তৃণমূলের বহু আসনেই বিজেপিকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে। কোনো দিক থেকেই কোনো অঙ্কেই বাম-কংগ্রেস সংযুক্ত মোর্চা এবারের নির্বাচনে তৃণমূলকে সুবিধেজনক স্পেস একটুও ছাড়বে না–সেটা সিপিএম রাজ্যসম্পাদকের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। গত দশবছরে বাম-কংগ্রেস এ রাজ্যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক স্পেস পায় নি। এটা তারা চেষ্টা করলেও খুব সহজে ভুলে যেতে পারবে না এবং ভুলতে চাইছেও না। কারণ, বিজেপিকে রাজ্য ছাড়া করার কাজটা ভবিষ্যতে তারাই করে দেখাতে চায়। অন্যদিকে প্রার্থী তালিকা নিয়ে বিজেপি’র ক্ষোভ-বিক্ষোভের বহর দেখে যারা খুশি হচ্ছেন তারা হতাশ হবেন–কারণ, বিজেপি’র এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ মূলত বিজেপি রাজ্যসভাপতি দিলীপ ঘোষের পছন্দের বহু প্রার্থী টিকিট না পাওয়ার কারণেই সঙ্ঘটিত হচ্ছে। দিলীপবাবু নিজেও টিকিট পান নি। আমি আগেই বলেছিলাম ওঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপদে বসানো হবে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ওঁকে নির্বাচিত করলে অল্পস্বল্প ব্যবধানে নিরঙ্কুশ জয় পেলেও সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে। বাংলা দখলের স্বপ্ন সফল হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে এত বড় ঝুঁকি বিজেপি’র পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না ! বিজেপি’র ক্ষোভ-বিক্ষোভও দ্রুত স্তিমিত হতে চলেছে।
কিন্তু ভোট শুরুর মাত্র দিন ছয়েক আগেও বাম-কংগ্রেস জোট যে দানা বেঁধেছে সেটা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। অধীরবাবু জোটের অঙ্কে খুবই যে কাঁচা সেটা আবারও প্রমাণ হতে চলেছে। অধীরবাবু যে পরিকল্পনায় এগোতে চাইছেন সেখানে তিনি ত্রিশঙ্কু ফলাফলের সম্ভাবনাই দেখছেন। তাঁর বিশ্বাস যতগুলো আসন না পেলে তৃণমূল ক্ষমতায় বসতে পারবে না ততগুলো আসন কংগ্রেসের দখলে আসবে এবং কংগ্রেস তৃণমূলকে প্রযোজনীয় সমর্থন দিয়ে সরকারের শরিক হবে। তৃণমূলকে তারা প্রভাবিতও করতে পারবে। কিন্তু তেমন কিছু হতে যাচ্ছে না। কংগ্রেস উপযুক্ত সমর্থন দেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের জায়গায় যাচ্ছে না। জোট বা সংযুক্ত মোর্চার ব্যাপারটি তিনিই কেঁচে দিয়ে সরকার গঠনের প্রশ্নে বিশেষ ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ হারাতে চলেছেন। ফলাফলকে প্রভাবিত করার সুযোগ কংগ্রেসের থাকবে বলে মনে হচ্ছে না।
যাইহোক, বহু রকমের জটিলতা, বহু রকমের পরিস্থিতি বদল, প্রার্থী তালিকা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ কমবেশি প্রভাব ফেলবে ফলাফলের ওপর। রাজ্যে প্রথম ভোট পড়বে আগামী শনিবার ২৭ মার্চ। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটা খুব সহজ নয়। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের যে পূর্বাভাস আমি প্রায় ১০০% মিলিয়ে দিয়েছিলাম–আজকের এই পূর্বাভাস ঠিক সেইরকমেরই হবে তা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। খুব বেশি হলে ২-৩% এদিক ওদিক হতে পারে। তবে, আজকের পূর্বাভাস ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত একই রকম থাকবে কিনা এখনই বলতে পারছি না। কারণ, ২৯ এপ্রিল চূড়ান্ত পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করবো। (চলবে)