এক বছর পেরিয়ে গেছে। ২০১৬ সালের এই দিনে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে রসরাজকে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশে দেয় একদল উগ্র লোক। তাদের অভিযোগ, রসরাজ দাস ফেসবুকে ইসলামের অবমাননা করেছে।
নাসিরনগর থানা পুলিশ রসরাজকে গ্রেফতার দেখিয়ে ওই দিন (২৯ অক্টোবর, ২০১৬) রাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় তার নামে একটি মামলা দায়ের করে।
এ মামলায় প্রায় আড়াই মাস জেল খেটে আদালত থেকে জামিনে মুক্তিপান তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রসরাজ দাস পেশায় একজন জেলে। বিলের ভেতরে মাছ ধরা অবস্থাতেই সেদিন ওই লোকগুলো তাকে ধরে এনে মারধরের পর পুলিশে দিয়েছিল।
সেই থেকে থানা-পুলিশ, মামলা, জেল-জামিনের ঝড় বয়ে যায় রসরাজের জীবনে। সামাজিক আর মানসিকভাবেও তিনি আজ বিপর্যস্ত। একের পর এক ভেঙে যাচ্ছে তার বিয়ের প্রস্তাব। কারণ, আজও তিনি সেই মামলার আসামি।
সেই অমানবিক হামলার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে রসরাজ দাস জানান, ‘অ্যাহন পরিস্থিতি আগের মতোই ঠাণ্ডা। বিলে গিয়া আমি মাছ ধরছি নিয়মিত। কেউ অহন আর আমারে কিছু কয় না। মাছ ধইরাইতো জীবন বাছাইতে হইব। অন্য কাম কাইজ জানি না। তয়, অমাবশ্যা পূর্ণিমা আইলে শরীরের বেদনার লাইগ্যা ঘুমাতে পারি না। রাতে ঘুমাইলে অহনো প্রায়ই ফালদা (চমকে উঠি) ওডি। মনে হয়, কেউ আমারে মারতে আইতাছে।’
ফেসবুকের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রসরাজ বলেন, ‘আমি তো ফেসবুকের ঘটনা সম্পর্কে কুনসতা (কিছুই জানি না) জানতাম না। লেহাপড়া জানি না ফেসবুক চালামু কেমনে? আমারে মারধর করার পর মাইনসের কাছ থেইক্যা জানছি, ফেসবুকে বলে আমি মুসলমান ভাইদের কাবাঘরের ওপর মূর্তি বওয়াইছি (বসাইছি)। কত বড় ঘটনা আমারে নিয়া সাজাইছে খারাপ মানুষেরা। কী আর কমু, মাইর আমার কপালে আছিল। বিনা কারণে মাইর খাওয়া খাইছি। অহনতো আর ভালো লাগে না। আমার বিরুদ্ধে মামলা দিছে পুলিশ। ঘটনার এক বছর পার অইল। জাল বাওয়া বন্ধ কইরা অহন খালি বানবাইরা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) কোর্টে যাইতে হয়। একটার পর একটা তারিখ পরে, কিছুই হয় না। জজ সাবও কিছু কয় না।’
বিয়ে করেছেন কিনা জানতে চাইলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে আক্ষেপের সঙ্গে রসরাজ জানান, দুই মাস আগে নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। দুই পক্ষের মধ্যে বর-কনে দেখাদেখিও হয়। মেয়েও তার (রসরাজের) পছন্দ। কথাবার্তা পাকা। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা বাকি ছিল। কিন্ত এক পর্যায়ে মেয়েপক্ষ বেঁকে বসে। তারা জানায়, ছেলের বিরুদ্ধে মামলা আছে। যেকোনও দিন জেলে যেতে পারে। এভাবে বিয়েটা ভেঙে যায়। এরপর সেই মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। এখনও বিভিন্ন জায়গা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু মামলার বিষয়টি জানতে পেরে পিছিয়ে যায় সব মেয়েপক্ষ।
রসরাজের বোন সুমনা রানী দাস বলেন, ‘পুরনো ঘটনা আর মনে করতে চাই না। আমার ভাইয়ের কপালে এমন পরিণতি ছিল, সে যা ভোগ করছে। এখনও মামলার ঝামেলা নিয়ে যে অবস্থায় আছে, এ থেকে মুক্তির কী উপায়। শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ায় আমাদের কপালে এই দুর্গতি জুটেছে।
একের পর এক আদালতে হাজিরা দিচ্ছে, কিন্তু কোনও ফল আসছে না। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে ভাইয়ের বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখছি। মামলার কথা শুনে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। আমরা তো জানি সে কোনও দোষ করেনি। তারপরও সরকার তদন্ত করে দেখুক, রসরাজ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। জড়িত না থাকলে এই ঝামেলা থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হোক।’
রসরাজের প্রতিবেশী বন্ধু নয়ন দাস ও সুখলাল দাস জানান, ‘রসরাজ দাসের মারধরের ঘটনা মনে হলে আমাদের কান্না আসে। যখন লোকজন মারধর করছিল, কেউ তাকে রক্ষা করতে যায়নি। সবাই দূর থেকে ঘটনা দেখছিল।
পরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন নাসিরনগরে হামলা- ভাঙচুর হয়, তখন মানুষ বুঝতে পারে যে, রসরাজ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না। এটি ছিল পরিকল্পিত ঘটনা। সংখ্যালঘু হওয়ায় তাকে ফাঁসিয়ে হামলাকারীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন ভূইয়া জানান, ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী রসরাজ দাসের মোবাইল থেকে ধর্ম অবমাননার ছবি আপলোডের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়ার পর চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি বিচারক রসরাজকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন।
মামলার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া বলেন, ‘ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও আদালতে কোনও প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। আমরা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। আমাদের বিশ্বাস দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে পুলিশের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ‘নাসিরনগরে হামলার ঘটনা তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। হামলা ঘটনার আগে ও পরে দায়ের করা মামলাগুলো পুলিশ সদর দফতর থেকে সরাসরি মনিটরিং করা হচ্ছে।