প্রাইভেট পড়ানোর নামে চলছে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য
বছরের পর বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে থাকার ফলে শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়। রাজধানীর ২৪টি সরকারি বিদ্যালয়ের অর্ধ সহস্র শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুদক। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তাদেরকে বদলির সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অপরদিকে শিক্ষকদের বদলি না করার পেছনে রাজনৈতিক চাপ, তদবির ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের নানা ধরনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত শুরু করে। গতকাল বুধবার তদন্ত টিম কমিশনে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, প্রতিবেদনটি কমিশনের কর্মকর্তা পর্যায়ে জমা হয়েছে বলে শুনেছি। কমিশনে উপস্থাপিত হলে কমিশন পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। তিনি বলেন, ঢাকায় প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে সুরম্য ভবনসহ শিক্ষার নানা উপকরণ রয়েছে। আমাদের মেধাবী শিক্ষকগণ রয়েছেন। তারপরও কেন শ্রেণি কক্ষের শিক্ষা-কোচিং সেন্টারে চলে যাচ্ছে?
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ৫২২ জনের মতো শিক্ষক ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত এক বিদ্যালয়েই রয়েছেন। অথচ সরকারি নীতিমালা মোতাবেক একই কর্মস্থলে ৩ বৎসরের অধিক সময় অতিবাহিত হলেই অন্যত্র বদলি করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইংরেজি শিক্ষক বা গণিত শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে ইংরেজি বা গণিতের শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে তা সমন্বয় করা হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করে বলা হয়েছে, ঢাকায় দশ বছরের বেশি কোনো শিক্ষক এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলে তাকে বিভাগের বাইরের বিদ্যালয়গুলোতে এবং পাঁচ বছরের বেশি সময় কর্মরত শিক্ষকদের ঢাকা নগরীর বাইরে এবং তিন বছরের বেশি সময় এক বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলে অন্য বিদ্যালয়ে বদলির সুপারিশ করেছে দুদক। ওই প্রতিবেদনে ঢাকার যেসব সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ৩২ জন, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৬ জন, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের ১৭ জন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪ জন, শেরেবাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৭ জন, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাই স্কুলের ২৫ জন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১ জন, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১ জন, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪ জন, মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯ জন, নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯ জন, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১ জন, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ২৯ জন, আরমানিটোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১ জন, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুলের ৯ জন, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩২ জন, বাংলাবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২২ জন, টিকাটুলী কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩০ জন, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৮ জন, শেরেবাংলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪ জন, ধানমন্ডি কামরুন্নেছা সরকারি বিদ্যালয়ের ৭ জন, ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ জন ও নিউ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলের ৭ জন।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশের সাত জেলা শিক্ষা অফিসারকে জেলায় দায়িত্ব না দিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও বরিশালের সাত বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহরীন খান রূপা, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেহেরুন নেছা, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নুরুন নাহার, ধানমণ্ডি কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাসরিন আক্তার, গাজীপুরের কালিগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের লুবনা আক্তার, চট্টগ্রামের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শাহিদা আক্তার ও বরিশালের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহবুবা খানম। এসব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বদলি নিশ্চিতের পাশাপাশি ভবিষ্যতে তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে পদায়ন না করতে বলা হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে।