৯ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ দুপুর ১:৪৩

এত ‘অনুভূতি’ ফেসবুকে কেন?

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ শনিবার, নভেম্বর ২৫, ২০১৭,
  • 824 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

কবির য়াহমদ ,প্রান্তিক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পৌঁছে যাওয়ার পর মানুষের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ অন্তর থেকে অবমুক্ত হয়ে ফেসবুকে এসে ঠেকেছে। ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচার, প্রসার আর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং বিষয়টি আশঙ্কাজনক মাত্রায়। ফলে কিছুদিন পর পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় কথিত ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের প্রকাশ পায় সন্ত্রাসী মাত্রায়, নিঃস্ব হয় মানুষ, প্রাণও হারায় কেউ কেউ, ঘর-বাড়িতে আগুন লাগানো হয়, লুণ্ঠন, ভাঙচুর হয়। শত শত মানুষের নির্যাতিত হয়ে যাওয়ার করুণ ও লোমহর্ষক ওই ঘটনার বিপরিতে প্রশাসন ধরে নির্যাতিতকে, নির্যাতিত জনগোষ্ঠী দ্বিতীয়বারের মত নির্যাতিত হয়; হতেই থাকে। এর শেষ হয়ত নেই, কে জানে।

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারি, মুসলমান। সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে আছেন হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ; এর বাইরে অন্য ধর্মের অনুসারির সংখ্যা নিতান্ত হাতেগোনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই দেশে হিন্দু সহ অন্য ধর্মের অনুসারিরা নিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, প্রাণ হারানোর শঙ্কায় দেশ ছাড়ছেন নিয়মিত। মাঝে মাঝে দেশছাড়া নন-মুসলিমদের তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসলেও প্রকৃত চিত্র এরচেয়ে অনেক বেশি। দৃশ্যমান নির্যাতনের বাইরে অদৃশ্যমান অনেক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা, কিন্তু সে তথ্য গণমাধ্যমে আসছে না, অথবা আসার সুযোগও কম। কেউ মুখ না খুলে নীরবে নির্যাতনের শিকার হতে থাকলে সে সংবাদ গণমাধ্যমে আসার সুযোগ যেমন কম, তেমনি প্রশাসনেরও কোন ভূমিকা পালনের সুযোগ সীমিত।

ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা ফেসবুকে স্থাপিত হয়ে যাওয়ার পর একশ্রেণির মানুষের সস্তা ধর্মীয় অনুভূতির নিয়মিতভাবে প্রকাশ হয়ে চলেছে। আর এই আগুনে অঙার হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সংখ্যায় লঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিপীড়নের শিকার হওয়া এসংখ্যা নেহায়েত কম না। যার সর্বশেষ নজির রংপুর ঠাকুরপাড়া, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতির ধোয়া তুলে নির্যাতিত হয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুরা। ফেসবুকে জনৈক টিটু রায়ের দেয়া এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত এবং এ অভিযোগে মামলার পর সংঘবদ্ধ ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা প্রশাসন-আইনকে তোয়াক্কা না করে মাৎস্যন্যায় চালিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আহত হয়েছেন পুলিশ সহ হামলাকারীদের অনেকেই, নিহতও হয়েছেন একজন। এরপর প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে কথিত ধর্মীয় অবমাননাকারী জনৈক টিটু রায়কে। আদালত দুই দফায় রিমান্ডে দিয়েছে তাকে। ধর্মীয় দুর্বৃত্তদের পর এটা তার ওপর দ্বিতীয় দফার আঘাত নিঃসন্দেহে।

পুলিশ রিমান্ডে অভিযুক্তকে আতিথেয়তায় নেওয়া হয় না। প্রচলিত ধারণায় ওখানে একপ্রকার নির্যাতন চালানো হয়। এটা হতে পারে শারীরিক কিংবা মানসিক, অথবা দু’ধরনেরই। রিমান্ড শেষে অনেক মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ পেয়েছে বলে দাবি করে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে অভিযুক্তের দেওয়া স্বীকারোক্তি আর আদালতে দেওয়া জবানবন্দির সাথে মেলে না। পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তি আর আদালতে দেওয়া জবানবন্দির মধ্যে স্বীকারোক্তি কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে বিচারের ক্ষেত্রে। ফলে রিমান্ডের স্বীকারোক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে জোরপূর্বক কিংবা বাধ্য হয়ে দেওয়া বলে অনেকেই মনে করে থাকেন; অন্তত তুলনামূলক বিচার আর বিচারিক ধর্তব্যে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেটা বলাই যায়। তাহলে কেন এ মানসিক কিংবা শারীরিক পীড়ন প্রক্রিয়া- এনিয়ে ভাবতে পারেন আইন সংশ্লিষ্ট ও আইনপ্রণেতারা!

টিটু রায় ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়েছেন কি না এ নিয়ে সরাসরি দুর্বৃত্ত আর দুর্বৃত্ত মানসিকতার অনুভূতিশীলরা ছাড়া আর কেউ নিশ্চিত না, কিন্তু তবু সেখানে ভয়ঙ্কর নাশকতার ঘটনা ঘটে গেছে। গত ১০ নভেম্বর ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে কয়েক হাজার মানুষ ঠাকুরপাড়ায় হামলা চালায়। তারা ১১টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক হামলাকারী নিহত এবং সাত পুলিশসহ ৩০ জন আহত হয়। হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এরপর ওই ঠাকুরপাড়ার টিটুকে ১৪ নভেম্বর ভোরে নীলফামারী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টিটুকে চারদিন রিমান্ডে শেষে আরও চারদিন অর্থাৎ মোট আটদিন রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার রিমান্ড শেষে টিটু রায়কে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে টিটু রায় দুই দফার রিমান্ডের সময়ে আদালতে কোন আইনজীবী পাননি, অর্থাৎ রংপুরের কোন আইনজীবী টিটু রায়ের মামলা চালাতে রাজি হননি। এরপর কয়েকটি সংগঠনের সহায়তায় দশ সদস্যের এক আইনজীবী প্যানেল গঠিত হয়, কিন্তু তারা টিটু রায়কে কারাগারে পাঠানোর আগ পর্যন্ত আইনি কোন সহায়তা দিতে পারেননি। অনেকটা গোপনীয়তায় টিটু রায়কে আদালতে হাজির করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, আদালত জবানবন্দি নিয়েছেন, এবং এরপর কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অথচ আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে অভিযুক্তের আইনজীবী উপস্থিত থাকার রীতি ছিল। এই রীতিরও ব্যতিক্রম হয়েছে; অথবা বলা যায় অনেকটা আইনকে তোয়াক্কা করা হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতি বিস্তৃত হওয়ার ন্যক্কারজনক উদাহরণ যে এটা তা বলা যায়।

টিটু রায়ের বিরুদ্ধে আনিত ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ যে ফেসবুক থেকে সঞ্চারিত হয়ে দেশের আইনি প্রতিষ্ঠানকেও করায়ত্ত করতে শুরু করেছে সে আশঙ্কা নিশ্চয়ই অমূলক না। এর আগে, একাধিকবার এধরনের ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ, প্রশাসন, সরকারের মন্ত্রীদের অনেকেই অভিযুক্তের ন্যায়বিচারের কথা উচ্চারণের চাইতে প্রমাণের আগে কথিত অভিযোগকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে অভিযুক্তদের নিয়ে কথা বলেছেন। আগেকার এধরনের বক্তব্যগুলো সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের উৎসাহি করেছে। বলছি না, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা সরাসরি অপরাধীদের পক্ষ নিয়েছেন, কিন্তু তাদের বক্তব্যগুলো নাশকতাকারীদের উৎসাহ না জোগালেও অন্তত ভয় ঢুকাতে পারেনি। ফলে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, এবং সেটা দেশের প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা না করেই।

মানুষের অনুভূতির জায়গা ফেসবুকে আশ্রয় নেওয়ার ফলে ধর্মীয় উপনালয়গুলো ক্রমে গুরুত্ব হারিয়ে ফেসবুককে ‘বিকল্প উপসনালয়’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কথাটা কটু শোনালেও এটাই বাস্তবতা। উপাসনালয়ে যাওয়ার আগে ফেসবুকে জানান দেওয়া, সচিত্র প্রমাণ উপস্থাপনকে এক্ষেত্রে প্রাথমিক স্মারক হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এটাকে সাদামাটা এক উদাহরণ অথবা সরলীকরণ হিসেবে মনে করলেও অনেকের অবস্থা দেখে মনে হয় এই সংবাদ আর ছবি বুঝি তাদের উপাসনাকে ‘কবুল/গ্রহণ’ করল। সাধারণ মানুষের এ প্রবণতায় আপত্তির কিছু না থাকলেও এটাকেই নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টায় ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা। সাধারণ মানুষ যে ধর্মীয় আচারকে ফেসবুকে প্রকাশ করে নিজেদের সাধারণ ভালোলাগাকে প্রকাশ করছে সেটাকে প্রচারের অন্যতম অনুষঙ্গ বিবেচনা করত নিজেদের মতাদর্শ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মত্ত কেউ কেউ। ফলে দেখা যায়, ধর্ম সম্পর্কিত কোনোকিছুতে অনেকেই আক্রমণাত্মক হয়ে যায়; যে অধিকাংশ সময়েই উপাসনালয়মুখী হয় না। এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ বাড়ছে ক্রমে, এবং এর প্রভাব পড়ছে সমাজের সকল স্তরেই।

ফেসবুকবাসীদের ধর্মীয় অনুভূতি যদি ইতিবাচকভাবে কেবল ধর্মের আচার-আচরণে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে সেখানে আপত্তির কিছু ছিল না; কিন্তু এর উগ্র রূপের প্রকাশে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। কথিত অভিযোগে একজনকে দায়ী করে বাড়ির পর বাড়ি লুট, ভাঙচুর করা হচ্ছে, সামাজিকভাবে প্রায় একঘরে করে দেওয়া হচ্ছে। দেশে থাকার পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর ওদিকে আক্রান্তদের বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ ও সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগের ইতিহাস বলছে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। অন্যদিকে তাকালে দেখা যায়, অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিঃস্ব হয়েছেন, দেশে বাসের অনুপযোগী পরিবেশ হয়ে গেছে তাদের। তাদের অনেকেই হয়ত চুপিসারে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়েছেন- সে সংবাদ কোথাও আসে নি বলে জানি না আমরা।

রংপুরের ঠাকুরপাড়ার ঘটনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন: জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ককে ধ্বংস করতেই ঠাকুরপাড়ায় হামলা হয়েছে। মন্ত্রীর এই বক্তব্যে মনে হয় রাজনীতিবিদরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাকে রাজনীতির মধ্যে রাখতে চান, এবং সেটা রেখেই যাচ্ছেন। তার বক্তব্যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দোষারোপের যে ইঙ্গিত সেটা প্রমাণ হয় না, কারণ নাসিরনগর সহ অনেক জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলার সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও অংশ নেওয়ার পাশাপাশি কেউ কেউ নেতৃত্বও দিয়েছিল বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। সুতরাং নির্বাচন আর ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এটা অনুভূতিশীলদের অনুভূতির চরম প্রকাশ সেটা স্বীকার করাই উচিত।

রংপুর হামলারামুর নাশকতার পর নাসিরনগরে হয়েছে, নাসিরনগরের অপরাধীরা শাস্তি পায়নি বলে ঠাকুরপাড়ায় হয়েছে- এমন করে আরও হয়ত আরও অনেক জায়গা লাইনে আছে, কে জানে; কারণ আমরা ফেসবুকে প্রকাশিত ধর্মীয় অনুভূতিকে সমূলে বিনাশের চাইতে জিইয়ে রাখতে আগ্রহী। বিনা বিচারের নাসিরনগরের রসরাজ দীর্ঘদিন জেল কেটেছে, ঠাকুরপাড়ার টিটুও একই পথে, এমনকি টিটুর জন্যে আইনজীবীও দাঁড়াতে পারছেন না আদালতে। এতে করে ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা উৎসাহী হচ্ছে, আর অনুভূতির তরবারিতে শান দিচ্ছে আরেক ঘটনার। বিপরীতে প্রশাসন, সমাজ সচেতন বলে মনে হচ্ছে না মোটেও।

ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো হরেক অনুভূতির মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশের ক্ষেত্র কেবল ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটা ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এসবের সত্যাসত্য না খুঁজে হামলে পড়ে প্রবল আক্রোশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর। এধরনের ঘটনা নিয়মিত বিরতিতে ঘটছে। এর রাশ টানা দরকার, তা না হলে সামাজিক-ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বন্ধনের ভিত তছনছ হয়ে যাবে আমাদের।

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »