বাইজী ঘরের শ্বেত পাথরটি এখনও অক্ষত আছে,
যেটির উপর বাইজী’রা বসে নাচ শুরু করতো।
পূর্ববঙ্গের সাতক্ষীরার সুন্দরন ঘেষা শ্যামনগরের জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ রায় চৌধুরীর ভগ্নদশা বাড়ির আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো পরগাছা আর বটবৃক্ষর শেকড়ে ক্ষয়ে যাওয়া মুমূর্ষু ইট গুলো বলে যায়,
“আজ আমি পরিত্যক্ত
জমিদারি মোর ফাঁকা,
তোমরা যারা ছিলে মোর উত্তরসূরী
কলকাতা থেকে কোনদিন দিবে নাকো দেখা ?
সুন্দরবন ঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ রায় চৌধুরী ১৮৮৮ সালে নকিপুর জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন।জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরীর মায়ের নাম ছিল নিস্তারিণী দেবী। কথিত আছে নিস্তারিণী দেবী অত্যন্ত ধার্মিক পরোপকারী স্বভাবের মানুষ ছিলেন এবং জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পূজোর ঘরেই পার করেছেন একবার তিনি স্বপ্নযোগে বহু সম্পদের সন্ধান পেলে রাতারাতি পরিবারের ভাগ্য পাল্টে যায়।এই পরিবারের বিষয়-সম্পত্তির পরিমাণ ছিল দুই লক্ষ একর। সমস্ত জমির খাজনা আদায় করতে ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ, কালীগঞ্জ এবং শ্যামনগর সুন্দরবনে ৭০০ কাছারি ছিল। জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী’র বাড়িটি ছিলো তৎকালীন সময়ে সুন্দরবন ঘেঁষা এই অঞ্চলের একমাত্র চোখধাঁধানো সুরম্য অট্টালিকা। মূল বাড়িটি ছিল সাড়ে তিন বিঘা জমির উপরে। প্রায় দেড় হাত চওড়া প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিলো পুরো জমিদার বাড়ি। সদর পথে ছিল একটি বড় গেট বা সিংহদ্বার। জমিদার বাড়ির সম্মুখে ছিল শান বাঁধানো বিশাল আয়তনের পুকুর। শতাধিককাল পূর্বে খননকৃত এই পুকুরটিতে সারাবছরই জল থাকে এবং গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে আজ অব্দি কেউ শুকাতে দেখেনি। পুকুরঘাটের বাম পাশেই ৩৬ ইঞ্চি সিঁড়ি বিশিষ্ট দ্বিতল নহবত খানা। আটটি স্তম্ভ বিশিষ্ট এই নহবত খানার ধ্বংসাবশেষটি এখনো প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে কালের সাক্ষী বহন করছে। বাগান বাড়িসহ মোট বার বিঘা জমির উপর জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাড়িটি ছিল সত্তর গজ লম্বা, ইউরোপীয় নকশায় তিন তলা বিশিষ্ট ভবন। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সম্মুখে সিঁড়ির ঘর। নিচের তলায় ঘরে জমিদার হরিচরণ বাবু জমিদার কার্যাদি সম্পন্ন করতেন নিচতলার অন্যান্য ঘর গুলো দেবদেবীর পূজার কাজে ব্যাবহৃত হতো। নিচের তলায় সর্বমোট ১৭টি এবং উপরের তলায় ৫টি কক্ষ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।শোনা যায় মোট ৪১ টি কক্ষ ছিলো জমিদার বাড়িটিতে। প্রথমবার ঢুকলে কোন দিকে বহির্গমন পথ তা বোঝা বেশ কষ্টদায়ক ছিল। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লৌহ কাষ্ঠের দরজা-জানালা, লোহার কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাদ, ভেতরে কক্ষে কক্ষে গদি তোশক, কার্পেট বিছানো মেঝে, এক কথায় রাজকীয় পরিবেশ। বাড়িতে ঢুকতে ৪টি কারুকার্য খচিত গেট ছিল। গেট ৪টি ছিল ২০ ফুট অন্তর।বাড়িটির মাঝের তলায় ছিলো কুল দেবতা গোপাল দেবের মন্দির ও অতিথি শালা।জমিদার হরিচরণ ১৯১৫ সালে মারা যান।
এরপর বিশাল জমিদারীর ভার পড়ে দুই ছেলের ওপর। তারাও বজায় রাখেন বংশের আভিজাত্য। তবে ১৯৩৭ ও ১৯৪৯ সালে দুই ছেলে মারা যান। এরপর ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটে। ১৯৫৪ সালে জমিদারের বংশধর সকল সহায় সম্পত্তি রেখে কলকাতায় পাড়ি জামান। সেই থেকে পড়ে আছে জমিদার বাড়িটি।জমিদার বাড়ির দক্ষিণ অংশের ভবন ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন চলছে মধ্যভাগের ভাঙন।বহু স্বাদ আর স্বপ্নে গড়া জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরীর এই বাড়িটি ধীরে ধীরে মাটির সাথে মিলিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিন ঢাকা পড়ে যাবে এর গৌরবময় সব ইতিহাস।