নাসিরনগরে ঘটে যাওয়া হিন্দু নির্যাতনের এক বছর পার হলেও এ ঘটনার বিচার কিংবা আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো ভূমিকা না রাখলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মৎস্যমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক রাজাকার সন্তান এবং বিএনপির লোকদের সঙ্গে ঠিকই পিরিতি বজায় রেখেছেন। দিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন শাখায় বিভিন্ন পদ-পদবি। অথচ নাসিরনগরে ৬০ শতাংশ হিন্দু বাসিন্দা রয়েছেন। তাদের ভোটই তাকে এই আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানেও তিনি এখানকার সংসদ সদস্য। পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও এবারই প্রথম তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। তবু হিন্দুরা ভীষণ কষ্টে। তবে মন্ত্রী ছায়েদুল বার্ধক্যজনিত রোগে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ বলছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলার অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে মন্ত্রী ছায়েদুলের ভাগ্নে ও নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাশেমকে রাখা হবে কিনা এর সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়েছে নাসিরনগর থানা পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে ভাগ্নে হাশেমকে দেখা গেছে। নির্যাতনের মামলায় একবছর ধরে ভাগ্নে আবুল হাশেমকে নিয়ে নাড়াচাড়া না হলে মঙ্গলবার থেকে হঠাৎ তৎপরতা বেড়েছে। এছাড়া হিন্দুরা যাতে নাসিরনগর ছেড়ে না যান সে জন্য স্থানীয় একাধিক হিন্দু বাসিন্দাদের মঙ্গলবার নাসিরনগর থানায় ডেকে নিয়ে বৈঠকও করেছে পুলিশ। বৈঠকে পুলিশ হিন্দুদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান পিপিএম বলেছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১০/১৫ দিনের মধ্যে নাসিরনগরের হিন্দু নির্যাতনের মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। তথ্য প্রমাণ খতিয়ে দেখাসহ ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নাসিরনগরের সংখ্যালঘু নির্যাতনে যারা জড়িত ছিল তাদের প্রত্যেকের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেন। এ ক্ষেত্রে তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে মন্ত্রীর ভাগ্নে হলেও কেউ পার পাবে না বলে জানান জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তা। মন্ত্রীর ভাগ্নের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে চার্জশিটে কার নাম থাকবে আর কার থাকবে না তা বলা উচিত না। তবে চার্জশিট জমা দেয়ার পর সেটি পাঠ করার অনুরোধ জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার।
নাসিরনগরের একাধিক হিন্দু বাসিন্দা বলেছেন, যাদের ভোট মো. ছায়েদুল হককে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে সাহায্য করেছে তাদেরই তিনি ‘পর’ করে দিয়েছেন। নাসিরনগরে নৌকা প্রতীকে শুধু যে মো. ছায়েদুল হক জিতেছেন তা নয়, নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং দুই ভাইস চেয়ারম্যানও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদেও ‘নৌকা’ প্রতীকের জয়জয়কার। তবু এখানে হিন্দুরা নির্যাতিত, উপেক্ষিত। রাজাকার সন্তানরা পুরস্কৃত।
পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়েছে, নির্যাতনের বর্ষপূর্তির দিনে স্থানীয় লোকনাথ মন্দিরে বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারেননি স্থানীয় হিন্দুরা। তারা বলেছেন, প্রতিবাদ সভার আগের দিনে অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর বিকেল থেকে স্থানীয় লোকনাথ মন্দির পুলিশ ঘিরে রেখেছিল। ২৯ ও ৩০ অক্টোবর সেখানে কাউকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। মন্দিরে সমাবেশ করতে না পেরে হিন্দুরা চলে আসেন নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেবের ব্যক্তিগত অফিসে। কিন্তু সেখানে লোকজনকে যেতে দেয়নি পুলিশ। শহরের পিটিআই মার্কেটে অবস্থিত অঞ্জন দেবের অফিসে ঢোকার দুই রাস্তাই সেদিন পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলে প্রতিবাদ সভাটি হয়নি। শুধু ৮/১০ জন জমায়েত হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি দেন।
মন্ত্রীর রাজাকার সন্তানপ্রীতি : মন্ত্রী ছায়েদুল হক দীর্ঘদিন ধরে নাসিরনগরের সাংসদ। তিনিই প্রথম ১৯৬৭ সালের দিকে নাসিরনগরে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু করান। শুরুতে তিনি হিন্দুদের মূল্যায়ন করলেও একপর্যায়ে সেটি কমতে শুরু করে। হিন্দুদের প্রতি মন্ত্রী ছায়েদুলের ভালোবাসা কমে রাজাকার সন্তান ও বিএনপিও লোকদের ওপর ভালোবাসা বেড়ে যায়।
সরজমিন ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রীর বদন্যতায় নাসিরনগরে রাজাকার সন্তানরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পদে অভিষিক্ত হয়েছে। এমনকি ছাত্রদলের সাবেক এক নেতাকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের নাসিরনগর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকও বানিয়েছেন মন্ত্রী। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে তিনি বর্তমানে নাসিরনগরের উপজেলা চেয়ারম্যান। অথচ মার খাওয়া হিন্দুদের বিচারের জন্য মন্ত্রীর দরদ নেই।
নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ফারুক মিয়া। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, ফারুক মিয়া রাজাকারের সন্তান। নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেবও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু মন্ত্রী ছায়েদুল তাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে এসেছেন। শুধু আনেননি, তাকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদও দিয়েছেন। ধরমন্ডল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বর্তমানে নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। এর আগে তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ের বিএনপির নেতা ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী ছায়েদুল তাকে আওয়ামী লীগে যুক্ত করেন।
নাসিরনগর উপজেলা যুবলীগের সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। তার বাবা কুখ্যাত রাজাকার অন্তর আলী। ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব বলেছেন, নাসিরনগরের রাজাকার তালিকায় অন্তর আলীর নাম উল্লেখ রয়েছে। রাজাকারের পুত্র জেনেও আমিনুল ইসলামকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল আওযামী লীগে এনেছেন এবং দলটির অঙ্গসংগঠন যুবলীগের নাসিরনগর উপজেলা শাখার সম্পাদকের পদ দিয়েছেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক।
নাসিরনগর উপজেলা যুবলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক ছিলেন নজরুল ইসলাম ওরফে কানা নজরুল। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় এলাকায় তার নাম দেয়া হয়েছে কানা নজরুল। এই কানা নজরুলের বাবার নাম ভাসানি মিয়া নাসিরনগরের তালিকাভুক্ত রাজাকার। সব জেনেও স্বাধীনতাবিরোধীর ছেলেকে নাসিরনগর আওয়ামী যুবলীগে এনেছেন মন্ত্রী ছায়েদুল।
জানতে চাইলে নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব বলেন, মন্ত্রীর কথা শুনলে মনে হয় তিনি না থাকলে নাসিরনগরের হিন্দুরা থাকতেই পারতো না। তার মতে, মন্ত্রী ভালোবাসা পেতে হলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার চাওয়া যাবে না। সম্পূর্ণভাবে মুখ বন্ধ রাখতে হবে। মুখ খুললেই বিপদ। অথচ এই অঞ্জন দেব গত বছর সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর মন্ত্রীকে ‘ধুয়া তুলসীপাতা’ প্রমাণ করতে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। বলেছিলেন মন্ত্রী হিন্দুবান্ধব। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে অঞ্জন দেবকে ছুড়ে ফেলে দেন মন্ত্রী। অঞ্জন দেবের অপরাধ ছিল তিনি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার দাবি করেছিলেন।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ নাসিরনগর উপজেলা শাখার সভাপতি কাজল জ্যোতি দত্ত নিজেও চাপের মধ্যে রয়েছেন। তবু তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মন্ত্রী ছায়েদুলের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক থাকার পরও মন্ত্রীকে দিয়ে হিন্দুদের উন্নয়নে কোনো কাজ করাতে তার ভীষণ বেগ পেতে হয়। এই সম্পর্কে চিড় ধরল কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক বিষয়ে নীরব থাকতে হবে এবং আমি নীরবই আছি। উল্লেখ্য, কাজল জ্যোতি দত্ত উপজেলার বনেদি ও প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারের সদস্য। তার পাকা বাসগৃহটির বয়সই শত বছরের ওপরে। তবু তিনি এ ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন।
মন্ত্রীর ভাগ্নেকে নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি :২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটেছিল। নির্যাতনের পর হামলায় জড়িত থাকাসহ হামলায় অংশ নেয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে যে কয়টি ভিডিও পাওয়া গেছে তার বেশ কয়েকটিতে মৎস্য মন্ত্রী মো. ছায়েদুল হকের ভাগ্নে ও নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাশেমকে দেখা গেছে। কিন্তু এত বড় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ ভিডিও ফুটেজে থাকলেও গত একবছর ধরে ভাগ্নে আবুল হাশেমকে নিয়ে কোনো তৎপরতা ছিল না বরং সে ঘটনাটির যাতে বিচার না হয় সে বিষয়ে নানা জায়গায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। গতকাল মঙ্গলবার‘হিন্দু নির্যাতনের বিচারের ভাগ্য মন্ত্রী ছায়েদুলের ভাগ্নের হাতে’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও নাসিরনগর থানা পুলিশ। সম্পূর্ণ ঘুমিয়ে থাকা একটি বিষয়ে জোরেশোরে চালানো হয় তৎপরতা। খুঁজে বের করা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মন্ত্রীর ভাগ্নে এই মামলার বিচার আটকাবে কেমন করে? এলাকায় হয়তো প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই মামলার গতিপথ সে বদলাতে পারবে না। কারণ ভাগ্নে আবুল হাশেমও এই মামলার একজন সন্দেহভাজন আসামি। সে-ই-তো এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি’ পাঠ করছে।
জানতে চাইলে নাসিরনগর থানার ওসি আবু জাফর বলেন, মন্ত্রীর ভাগ্নে আবুল হাশেমকে নাসিরনগরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলায় আসামি করা হবে কিনা-বিষয়টির সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চিঠি নাসিরনগরে আসার পরই এ ঘটনার চার্জশিট জমা দেয়া হবে। ভাগ্নে আবুল হাশেম আসামি কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের সিদ্ধান্তই বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধান দেবে। তবে কবে নাগাদ পুলিশ সদর দপ্তরে এই চিঠি পাঠানো হয়েছিল তা তিনি জানাননি। তার মতে, তদন্ত শেষ, চার্জশিটও প্রায় প্রস্তুত, কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে তা জমা দিতে দেরি হচ্ছে।
মৎস্যমন্ত্রী ছায়েদুল হক এমপি ৭৬ দিন ধরে হাসপাতালে : দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক এমপি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হার্ট, মূত্রথলিসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের কেবিন ব্লুকের ২১১ নম্বরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।