পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে উত্সবে-অনুষ্ঠানে মানুষের আনাগোনা বাড়লেও রবিবারের উপাসনায় খুব একটা লোক সমাগম হয় না। নতুন সদস্য যোগদানও প্রায় বন্ধ। তেমন প্রচারণাও হয় না এখন আর। উপাসনালয়ের ক্ষয়িষ্ণু ভবনের মত কমে গেছে আগের সেই জমজমাট আয়োজন।
পাটুয়াটুলীর ব্যস্ত সড়ক থেকে বোঝার উপায় নেই এখানেই এমন সুন্দর ছিমছাম এক মন্দির রয়েছে। লোহার গেট পেরিয়ে রেলিং ঘেরা বাগান, ফুলের গাছ এসবের মাঝেই ছিমছাম উপাসনালয়টি চোখে পড়ে। বাইরে যেমন ভেতরেও উপাসনালয়টি নিরাভরণ। প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় হয় উপাসনা। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১১ মাঘ (২৪/২৫ জানুয়ারি)।
ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজের এই মন্দিরে ১৯২৬ সালে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেবার এই উপাসনালয়ে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। এখনো সেখানে বসেই চলে ঈশ্বরের আরাধনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ফাঁকে ফাঁকে আচার্য বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন। যেভাবে শুরু:সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজ শুধু ঢাকায় নয়, সারা ভারতেই কূপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে প্রগতিশীল আধুনিকমনস্ক হয়ে উঠবার একটা প্ল্যাটফর্ম দিয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে ভারতে ইংরেজরা যখন ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভেদ টেনে রেখেছিল তখন ব্রাহ্ম সমাজ ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ এর এক নতুন পথের দিশা নিয়ে হাজির হয়েছিল মানুষের সামনে। সারা ভারতে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে।
‘ঢাকা সমগ্র’ বইয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির প্রতিষ্ঠায় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ও সুচিত্রা সেনের শ্বশুর দীননাথ সেন প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ পরিচিত ছিল ‘ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে। ১৮৪৬ সালের দিকে ব্রজসুন্দর মিত্র, যাদবচন্দ্র বসু, গোবিন্দচন্দ্র বসু, রামকুমার বসুসহ অন্যরা মিলে ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলন শুরু করেন। প্রথম দিকে ব্রাহ্ম সমাজের সভ্যদের বাড়িতেই এর কার্যক্রম চলত। তবে ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ব্রজসুন্দর মিত্রের ভাড়াবাড়িতে। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৯ সালে কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক দীননাথ সেনের উদ্যোগে ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজের এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় ভবনটি নির্মাণে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। মন্দিরটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নবাব আব্দুল গনি, নবাব আহসানুল্লাহ, ত্রিলোচন চক্রবর্তী, জোয়াকিন পোগজসহ স্বনামধন্য ব্যক্তিরা।
জানা যায়, ব্রাহ্মদের মধ্যেও এখন দুটি ভাগ হয়েছে। একটি হলো জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম, অন্যটি অনানুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মধ্যে যারা ব্রহ্মধর্ম সমর্থন করেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি, তারাই অনানুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। তারা সমাজের সদস্যও হতে পারেন। এ ছাড়া দীক্ষালাভের মাধ্যমেও ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়া যায়। বর্তমানে সারাদেশে মোট ব্রাহ্মের সংখ্যা কয়েকশ’। ব্রাহ্ম সমাজের কার্যনির্বাহী কমিটি সাত সদস্যের। এ ছাড়া সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডও আছে। তারা মন্দিরসহ সব সম্পদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন।
মন্দিরের বর্তমান আচার্য সবুজ কুমার পাল দীপক। প্রার্থনাসভা তিনিই পরিচালনা করেন। দীপক জানালেন, ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ আসতে পারে। বিশেষ কিছু দিনে মন্দিরে উত্সব হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে বাংলা সনের ১১ মাঘ বিশেষ কর্মসূচি থাকে। তখন এখানে বেদের সঙ্গে সঙ্গে কোরআন, ত্রিপিটক, বাইবেলও পাঠ করা হয়। এ ছাড়া পয়লা বৈশাখে রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করেন ব্রাহ্মরা।
এখন অবশ্য ব্রাহ্ম সমাজের সেই রমরমা অবস্থা নেই। উত্সবে অনুষ্ঠানে কিছুটা লোকসমাগম হয়। সাপ্তাহিক প্রার্থনায় হাতেগোনা মানুষ আসে। যেমন পাওয়া গেল হাতেগোনা কয়েকজনকে। আচার্য জানালেন, নতুন করে আর কেউ এই সমাজের সদস্য হচ্ছেন না। প্রচারণার কাজও এখন বন্ধ।
যুগান্তকারী কিছু কাজ: ঢাকার ইতিহাসে যুগান্তকারী বেশকিছু কাজ করেছে ব্রাহ্ম সমাজ। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার প্রথম নারী বিদ্যালয় (যা এখন ইডেন মহিলা কলেজ), জগন্নাথ স্কুল (যা এখন বিশ্ববিদ্যালয়), উপমহাদেশে উল্লেখ করবার মতো লাইব্রেরি ‘রাজা রামমোহন লাইব্রেরি’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা। ওই পাঠাগারে পড়াশোনা করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি শামসুর রাহমান, মিজানুর রহমান, কাজী মোতাহার হোসেনসহ অনেকে।
রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরিটি একসময় খুব সমৃদ্ধ ছিল। ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরিতে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে। ১৯১০ সালে লাইব্রেরির জন্য উপাসনালয়ের ভেতরে একটি ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে তা উপাসনালয় ভবনে সরিয়ে নেয়া হয়। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে দেয়। সেই সময় লাইব্রেরিটির অনেক বই নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সবুজ কুমার পাল জানান, লাইব্রেরিটি নতুন আঙ্গিকে করবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রাজা রামমোহন রায় ও ব্রাহ্ম সমাজ:রামমোহন রায় আধুনিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেশের মানুষকে অতীতমুখী, মধ্যযুগীয় মানসিকতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক নতুন যুগের জীবন দর্শনের আলো দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। রামমোহন হয়ে উঠেছিলেন ঊনবিংশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম এক নায়ক।
বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ গঠন করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্মরা (এ ধর্মের অনুসারী) নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন। এ সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করা। এর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে।
সতিদাহ প্রথা বাতিলসহ নানা সংস্কারমূলক কাজের জন্য রাজাকে ঘিরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়েই ১৮১৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘আত্মীয় সভা’। প্রতি সপ্তাহে এক দিনের অধিবেশন হত বিভিন্ন সদস্যের বাড়িতে। সেখানে উপস্থিত থাকতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীশঙ্কর ঘোষাল, রাজনারায়ণ সেন, কৃষ্ণমোহন মজুমদার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ। আর এই আত্মীয় সভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ব্রাহ্ম সমাজ।
রাজা রামমোহন রায় মনে করতেন, প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশগুলো তিনি গ্রহণ করবেন। ১৮২৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্মসভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাত্ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এ নবপ্রতিষ্ঠিত সমাজের মূল দাবি ছিল যে এটাকে সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে এটি হিন্দুধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয়।
১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। এরপর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনটি বাধার মুখে পড়ে। রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অসম্পূর্ণ কাজটি হাতে নেন। তার নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনটি নতুন মাত্রা পায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।