২রা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৭:২০
ব্রেকিং নিউজঃ

কায়স্থরা আসলে শুদ্রবর্ণ♪ ব্রাত্যজনের দর্শন ০৩ :

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ রবিবার, ডিসেম্বর ৩, ২০১৭,
  • 7742 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

লেখকঃ ভানুলালা দাস , ব্রহ্মবৈবর্তপুরানে বাঙালির অনেক জাতপাতের উল্লেখ থাকলেও কায়স্থ বা বৈদ্যের উল্লেখ নেই।

প্রাচীন বাংলায় অম্বষ্ঠ জাতি চিকিৎসা করতেন এবং করণরা রাজকার্য চালনায় সহায়তা করতেন ও লিপিকরের কার্যে জড়িত ছিলেন। এই দুই সংকরবর্ণ পরবর্তীতে বৈদ্য ও কায়স্থ হিসেবে পরিচিত হয়।
কায়স্থ কোন বর্ণ নয়, বরং বর্তমান যুগের আমলার মতো পেশাগত একটি নাম। এই পেশার লোকজনের কর্ম ছিল রাজকার্যে সহায়তা করা, লিপিকার, রাজস্ব আদায়, সেনাবাহিনীতে কাজ, রাজার প্রত্যহিক সেবাযত্ন করা। বাঙালি হিন্দু সমাজে জলছোঁয়া জাত হিসেবে বর্ণসংকর করণ এই পেশায় কালক্রমে বহুলাংশে নিয়োজিত হয়। ফলে করণশুদ্ররা কায়স্থ নামে পরিচিতি পায়। এজন্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কায়স্থ নামে কোন বর্ণসংকরের নাম নেই, সেই সময় সম্ভবত করণ জাতি কায়স্থ হিসেবে পরিচিতি পায়নি।
মনু সংহিতা অনুসারে যেহেতু করণ হল বৈশ্য পুরুষ ও শুদ্রনারীর সন্তান, তাই অনুলোম নিয়মানুসারে তারা মাতৃবর্ণের অর্থাৎ শুদ্র। এ জন্য কায়স্থদের পদবিতেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। শুদ্রদের মত নানা রকম পদবি দেখা যায় কায়স্থদের মাঝে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে করণদের স্পষ্টভাবে শুদ্র বলা হয়েছে।
বর্ণসংকরের মধ্যে অম্বষ্ঠ ও করণ শ্রেষ্ঠ বলে কথিত। এখনো বাঙালি সমাজে ব্রাহ্মণের পরেই বৈদ্য ও কায়স্থের নাম বলা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এতকিছুর পরেও শাস্ত্রানুসারে কায়স্থ ও বৈদ্য হল শুদ্র। কারণ, তারা কোনক্রমেই বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ এই তিন দ্বিজবর্ণ ভূক্ত নয় এবং তারা নিজেরাও কখনো এমন দাবি করেন না।
ফলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল, বৈদ্য কায়স্থ বনিক শীল তন্তুবায় ইত্যাদি বর্ণসংকর মর্যাদা নির্বিশেষে সকলে শুদ্রমন্ডলীর অন্তর্ভূক্ত।

আরেকটি জনপ্রিয় মতবাদ হল, মহারাজা আদিশূর নামক জনৈক সামন্তরাজ কাণ্যকুব্জ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনেন। এই পাঁচজন ব্রাহ্মণের সংঙ্গে দেহরক্ষী কিংবা ভৃত্য হিসেবে পাঁচজন কায়স্থ আনেন। তাদের পদবি ছিল ঘোষ, বসু, গুহ, মিত্র ও দত্ত। এদের বংশধররাই কুলিন কায়স্থ নামে অভিহিত।

প্রশ্ন হল, এই কুলিন কায়স্থরা কোন বর্ণের ছিলেন? কেউ কেউ বলেন, তারা ক্ষত্রিয় বর্ণের ছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয়নি; কারণ ক্ষত্রিয়রা হল চতুর্বর্ণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট দ্বিজবর্ণের হিন্দু, তাদের দ্বিতীয় সংস্কার বা উপনয়ন হয় এবং তারা পৈতা ধারণ করে। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সাহচর্যে বসবাস করে তারা দ্বিজত্ব হারালেন কিভাবে? বেদপাঠের অধিকার কই গেল?
পান্ডববর্জিত বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় তাদের অব্যবহতি বর্ণের ক্ষত্রিয়দের দ্বিজত্ব অতিযত্নে সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হল, বাঙালি কায়স্থরা বেদপাঠী নয়, পৈতাধারীও নয়। ব্রাহ্মণের সেবা করা শুদ্রেরই কাজ। দ্বিজবর্ণের ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণের ভৃত্য হওয়া হিন্দুশাস্ত্র বিরোধী।
ব্রাহ্মণেরাও কায়স্থদের কখনও দ্বিজবর্ণ বলে গণ্য করেন না। তাই আগন্তক ব্রাহ্মণের দেহরক্ষী বা ভৃত্য হিসেবে আগত পাঁচ কায়স্থর পূর্ব পুরুষ শুদ্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের বেশ ক‘টি গল্পে কায়স্থদের শুদ্র বলা হয়েছে।
ব্রাহ্মণরা কায়স্থ বৈদ্যদের দ্বিজবর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তারা নিজেরা ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ এর মতো নিজেরা শুদ্রদের চেয়ে উচ্চ ও আলাদা বর্ণ ভেবে তৃপ্তিবোধ করেন। কিন্তু জিজ্ঞাস্য হল, তারা শুদ্র না হলে তারা কী বর্ণের? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কোনটি?

চতুবর্ণের বাইরে আর কোন বর্ণ মনুসংহিতা স্বীকার করে না।
‘ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য, এই তিন বর্ণ দ্বিজ। চতুর্থ শৃদ্রের একজন্ম – তার দ্বিজত্ব নেই। পঞ্চম কোন বর্ণ নেই।’ (মনুঃ ১০/৪)।

বর্ণসংকর বৈদ্যের উদ্ভব :
বৈদ্যরা বলেন, তারা অম্বষ্ঠ বর্ণসংকর থেকে উদ্ভূত। অম্বষ্ঠ হল ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান। অনুলোমক্রমে অম্বষ্ঠ সন্তান মাতার বর্ণ বৈশ্যবর্ণ পাবে। বৈশ্যরা দ্বিজবর্ণের বিধায় অম্বষ্ঠরা পৈতাধারী ও বেদপাঠী হবে। বাঙালি বৈদ্য যদি অম্বষ্ঠ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তবে তারা বৈশ্যবর্ণ হিসেবে পরিচিত নয় কেন এবং যদিও তারা উপনয়ন সংস্কার করেন থাকেন। অম্বষ্ঠ থেকে বৈদ্য জাতির উদ্ভূত, এমন মতামত ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বৈদ্যরা দাবি করেন, অর্থর্ববেদ চিকিৎসা সম্বলিত শাস্ত্র, তারা অর্থর্ববেদী এবং বেদপাঠের অধিকারী। অতএব তারা দ্বিজবর্ণ। সর্ব প্রাচীন ঋকবেদে সামবেদ ও যর্জ্জুরবেদের উল্লেখ থাকলেও অর্থর্ববেদের উল্লেখ নেই। এ বেদ পরবর্তীকালের, অধিকন্তু এ বেদপাঠের অধিকার বৈদ্যের ছিল, এমন প্রমাণ নেই। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ যা বাঙালি জাতপাতের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত, সেখানে অম্বষ্ঠ ও করণদের শুদ্রবর্ণের উত্তম সংকর বলা হয়েছে। তাই বৈদ্যজাতি শুদ্রবর্ণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

শুদ্রের ভেতর উত্তম, মধ্যম, অধম এ ধরণের অযৌক্তিক বিভাজন মহাজাতি শুদ্রকে বিভাজনের কূট কৌশল মাত্র। এ কৌশলের দ্বারা যুগ-যুগান্তর আধ্যাত্মিক, জাগতিক,
সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা, বৈষম্য, অবিচার ধর্মের নামে চালাতে আর্য ত্রিবর্ণদের বড় সুবিধা হয়েছে। ‘ধর্মের নামে আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা’ এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর নেই। এরপরেও জেনে বুঝে যারা জাতপাত মানছেন ও এর মাহাত্ম্য প্রচার করে চলেছেন তারা জেগে ঘুমাচ্ছেন এবং অন্যদের ঘুমুতে বলছেন।
যারা ঘুমায় তাদের জাগ্রত করা যায়, এমনকি কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভাঙানো যায়, কিন্তু ইচ্ছে করে যারা চোখ বুজে থাকেন তাদের নিদ্রা কি ভাঙ্গানো যায়?

কায়স্থরা প্রকৃতপক্ষে শুদ্রবর্ণ–কোলকাতা হাইকোর্ট :

অনেক বছর আগেই কায়স্থদের সর্ম্পকে কোলকাতা হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে উল্লেখ করেছেন যে, কায়স্থরা শুদ্র ব্যতিত অন্য কিছু নয়। মহামান্য বিচারকবৃন্দ কায়স্থ জাতির বিয়য়ে প্রচলিত তিনটি মতামত বিবেচনা করেই এই রায় দিয়েছেন-

(১) করণ থেকে কায়স্থ উৎপন্ন হলে, মনুসংহিতার মতে, অনুলোম নিয়মানুসারে এরা শুদ্র। কেননা, বৈশ্য পিতা ও শুদ্র মাতার সন্তান হল করণ। তারা মাতার বর্ণ অর্থাৎ শুদ্রবর্ণের বর্ণশংকর।

(২) কায়স্থ কোন জাতিবাচক শব্দ নয় এটি একটি শ্রেণী বিশেষের নাম। কায়স্থ বলতে প্রাচীন বাংলায় এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীদের বুঝাত। বর্ণসংকর করণরা কালক্রমে কায়স্থের দায়িত্ব অর্থাৎ রাজকর্মচারীর দায়িত্ব পালন করতো বিধায় পরবর্তীতে করণ শুদ্ররা কায়স্থ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ দৃষ্টিভঙ্গিতেও কায়স্থরা শুদ্রবর্ণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

(৩)কুলিনতা বা জাতির আভিজাত্য নির্ণিত হয় ‘কুলজী গ্রন্থ’ অনুসারে। এই গ্রন্থ অনুসারে, মহারাজ আদিশুর কর্তৃক আনীত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সঙ্গে যে, পঞ্চ-ভৃত্য বঙ্গদেশে এসেছিল তারাই ঘোষ,বসু,গুহ,মিত্র,দত্ত প্রভৃতি কুলিন কায়স্থের আদিপুরুষ। যেহেতু ব্রাহ্মণের ভৃত্য, তাই কায়স্থের পূর্ব পুরুষ অবশ্যই শুদ্র। শুদ্রের জন্য দ্বিজবর্ণের সেবাই ধর্ম। দ্বিজের সেবক শুদ্র ছাড়া কিছু নয়।

এ ছাড়াও দত্তক আইন এবং পুরাণে বলা হয়েছে কায়স্থরা শুদ্র।
(৪) হিন্দু ‘দত্তক আইন’ এ বলা হয়েছে, ‘বাঙালি কায়স্থ এবং নমশুদ্র উভয়ই শুদ্র শ্রেণিভূক্ত।’ তাই কায়স্থ কর্তৃক নমশুদ্র সন্তানকে দত্তক গ্রহণ আইনসম্মত (২৮ ডি এল আর ৩১৩)।

(৫) বৃহদ্ধর্মপুরাণে করণদের (যে বর্ণশংকর থেকে কায়স্থদের উৎপত্তি) শুদ্র বলা হয়েছে।

কোলকাতা হাইকোর্ট সমুদয় শাস্ত্র প্রমাণাদি ও ঐতিহাসিক তথ্য বিচার বিবেচনা করতঃ কায়স্থদের শুদ্রবর্ণ বলেছেন। তাছাড়া কোর্ট মন্তব্য করেছেন, এতকাল যাবৎ ব্রাহ্মণেরা কখনো কায়স্থদের দ্বিজবর্ণ বলে স্বীকার করেন নাই এবং এদের উপনয়ণ বা পৈতা সংস্কারও চালু নেই। কায়স্থরাও নিজেদের দ্বিজবর্ণ বলে দাবি করেছেন, এমন কখনও শুনা যায়নি।
তবে, কানে কানে ফিস ফিস করে কায়স্থরা বলাবলি করে তারা পতিত ক্ষত্রিয়– কালক্রমে ক্ষত্রিয় ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন।
হায় হায়! কি আপসোস! কী আপসোস!!

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »