২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ সন্ধ্যা ৭:১৮
ব্রেকিং নিউজঃ

হিন্দু সমাজ সিমেন্টহীন ইটের গাঁথুনি♪ ব্রাত্যজনের দর্শন ০৫ :

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ বুধবার, ডিসেম্বর ৬, ২০১৭,
  • 881 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

বিখ্যাত কবি ও লেখক বুদ্ধদেব বসু, কুলিন কায়স্থ হয়েও, গর্বভরে নিজের পরিচয় দিতেন, ‘আমি অনার্য, আমি ব্রাত্যজন এবং আমি ভূমিপুত্র।’
কারণ তিনি ইতিহাসকে স্বীকার করে আত্ম-পরিচয় আবিস্কার করেছিলেন, তাই সত্যকে বরণ করে নিতে তার দ্বিধা ছিল না তাঁর। বাঙালি হিন্দু সমাজের শুদ্রবর্ণের উত্তম বর্ণসংকরদের কতিপয় গোষ্ঠি নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে অতিশয় মানসিক দৈন্যতার কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদী কৃত্রিম বিভাজনকে সমর্থন করেন এবং শুদ্রদের অন্য বর্ণশঙ্করের চেয়ে নিজেদের উচ্চতর মনে করেন। তারা মনুস্মুতি ভুলে যান–

‘ ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয় বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ
চতুর্থ একজাতিস্ত শুদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।’
মনুঃ ১০/৪

–ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য, এই তিন বর্ণ দ্বিজ। চতুর্থ শৃদ্রের একজন্ম – দ্বিজত্ব নেই। এ ছাড়া পঞ্চম কোন বর্ণ নেই।

চতুর্বর্ণের অতিরিক্ত কোন বর্ণ হিন্দু ধর্মে নেই। কায়স্থ, বৈদ্য বা জলছোঁয়া জাত বলে কোন পৃথক বর্ণ হিন্দুশাস্ত্রে নেই। এই সত্য স্বীকার করতে এত দ্বিধা ভয় লজ্জা কেন? সব শুদ্র বর্ণশঙ্কর আসলে শুদ্রবর্ণের হিন্দু।
তারা আরও ভুলে যান যে, কুলিন ব্রাহ্মণ, পতিত ব্রাহ্মণ সকলেই ব্রাহ্মণ এবং শ্রেণীস্বার্থে তারা কাউকে ছাড় দেয় না। কিন্তু বাঙালি উত্তমসংকর কায়স্থ, বৈদ্য বা জলছোঁয়ারা নিজেদের দিনরাত শুদ্র থেকে উচ্চতর মনে করলেও ব্রাহ্মণ্য সমাজ তাদের শুদ্র ভিন্ন অন্য কোন উচ্চবর্ণে স্থান দেয়নি কোনদিন। দ্বিজবর্ণের প্রাণপন সেবাশুশ্রূষা ও তল্পিবহন করে কোন ফায়দা হয়েছে কি?

ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ব্যাপক অনুপস্থিতিতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ উত্তম বর্ণ শঙ্কর শুদ্রদের হাত করেছিলেন নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে। শাসকগোষ্টী
শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য বৃহৎ জনগোষ্ঠিকে ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জাতপাত ইত্যাদি রাবিস বিষয়ে ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু তল্লীবাহক ও তোষামোদকারী তথাকথিত উত্তম বর্ণ শঙ্কর শুদ্রদের দ্বিজবর্ণে গ্রহণ করার অনুমতি ব্রাহ্মণগণ কখনও দেননি।

হিন্দু সমাজ সিমেন্টহীন ইটের গাঁথুনি

সনাতন হিন্দুধর্মকে টিকে থাকা এবং পরিপুষ্টতার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্য সমাজকে বৈষম্য ভেদাভেদ তিরোহিত করে একত্রিত করা একান্ত প্রয়োজন। যে কোন মানব গোষ্ঠির একক জাতিসত্তা ও নিরাপত্তাবোধ এবং অন্য বহিরাগত গোষ্ঠির আগ্রাসনে টিকে থাকার জন্য নিজেদের ভেতর কঠোর অটল ঐক্য প্রয়োজন।

সমাজ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সূত্র হলো, রক্ত সর্ম্পকই হল সর্ব শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ঐক্য-সূত্র। বর্ণাশ্রমবাদী হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ, গোত্রভেদ তো আছেই, তন্মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অনুলোম-প্রতিলোম বিধান করে রক্ত সম্পর্ককে আরও অসম্ভব জটিল করে দেয়া হয়েছে। ফলে হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু সমাজে চতুর্বর্ণ পাশাপাশি বসবাস করে, একই মন্দিরে যাতায়াত করেও এক জাতিসত্তা হতে পারেনি। অখন্ড হিন্দু সমাজ আজও গঠিত হয়নি। এ এক অদ্ভূত সমাজ ব্যবস্থা!
উপর থেকে মনে হবে এরা এক ধর্ম, এক ঈশ্বর, এক দেবতায় বিশ্বাসী; কিন্তু ভেতরে ভেতরে জাতপাতের বিভাজনে শতধা বিভক্ত। ইটের উপরে ইট সাজালেই শক্ত কাঠামো হয় না। ফাঁকে ফাঁকে সিমেন্ট দিলেই শক্ত কাঠামো আকার পায়।
রক্ত সম্পর্ক স্থাপনের সহজ সুযোগ দেয়া হলে ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজ গঠন হতে পারে। এজন্য মনুর অবৈজ্ঞানিক, বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী অনুলোম-প্রতিলোম বিধান অগ্রাহ্য করা জরুরী। শিক্ষিত উত্তম বর্ণসংকরদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া দরকার এবং ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’ নীতিতে জীবনাচরন ও ধর্মকর্ম পরিচালনার উদ্যোগ ও দৃষ্টান্ত স্থাপন এখন যুগের চাহিদা। নিজেদের রুট বা শেকঁড় খুঁজে পেয়ে অত্মপ্রবঞ্চনা ত্যাগ করে মহা সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। আর এ মহাসত্য হল, “আমি তুমি ও সে আমরা সকল বাঙালি বর্ণসংকরই আসলে শুদ্র।”

আমরা অধীর আগ্রহে কান পেতে আছি, সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য যখন উত্তম-মধ্যম-অধম সংকর, এমন ছত্রিশ বা একচল্লিশ জাতি উপজাতির অন্তঃবিভক্তি লোপ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ শুদ্ররা এক মহাজাতিতে পরিণত হবে।
মানুষ যে দিন বুঝতে পারে, সে শৃঙ্খলিত বা বন্দী, সেদিনই তার অর্ধমুক্তি ঘটে; কারণ মুক্তির প্রচেষ্ঠা তখনই সে শুরু করে এবং মুক্তি অর্জনও সম্ভব হয়। মহাজাতি শুদ্রের প্রজ্ঞাবানরা নিজের উৎস বা শেকড় খুঁজে পাবেন কি?
শিক্ষিত হিন্দু মাত্রই এখন ছাপার অক্ষরে ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারেন। পড়ে এবং বুঝে এর মূলসূত্র গ্রহণ করে নিজেদের উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করতে পারেন সহজেই। সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চার ব্যতিত সনাতন ধর্মের ক্ষয়িষ্ণুতা রোধ করার আর উপায় নেই।
আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি, যে দিন সংখ্যা গরিষ্ঠ অনার্য সমাজ নিজের উৎস ও শেকড় খুঁজে পাবেন এবং দ্বিধাহীন দীপ্তকন্ঠে ঘোষণা করবেন, ‘মানুষ অমৃতের পুত্র, মানুষ মাত্রই ব্রহ্মকণা। ব্রহ্মের কোন জাত নেই, তাই হিন্দুর কোন বর্ণ বা জাত থাকতে পারে না। অনুলোম, প্রতিলোম, বর্ণসংকর এসব ব্রহ্মসন্তানদের বেলায় একেবারেই বাহুল্য ও অপ্রযোজ্য।’
ঐতিহাসিক সেই শুভদিনের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে কান পেতে রই, যেদিন মহাজাতি শুদ্র থেকে একজন অবতার পুরুষ আর্বিভূত হয়ে দীপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করবেন :

‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ-
চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম –
সে কখনো করে না বঞ্চনা।’

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »