বারকোনা গ্রামে নাকি ১২টি কোনা পেরিয়ে যেতে হয়। আমার মনে হলো রূপম ভাই অন্তত ৩৬ বাঁক নিলেন। পরোপকারী মুস্তাফিজুর রহমান রূপম থাকেন দিনাজপুরে। ভাবনা নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান তিনি। করোনাকালীন সাবধানতা হিসেবে নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিলেন পার্বতীপুরের বারকোনা গ্রামে। কাঙ্ক্ষিত বাড়িটিতে পৌঁছানোর জন্য খুব সুনসান না হলেও নিরিবিলি একটা পথ হেঁটে যেতে হলো। এরপর বাড়ির খোলা চত্বর পেরিয়ে মূল আঙিনায় পৌঁছালাম। তখন রাত দুই প্রহর শুরু হয়েছে। ঢুকতেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া বেশ কিছু ছেলেমেয়ের ভিড় এড়িয়ে যিনি চোখটা নিজের দিকে টেনে নিলেন, তিনি তখন ছেলেমেয়েদের খাওয়াদাওয়া তদারকি করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনিই এই বাড়ির কর্ত্রী এবং খ্যাতিমান আদিবাসী নেতা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্ত্রী। তার মেয়ে শিল্পী সরেন, মেয়ের জামাই মারিও সুইটেন মুর্মু, ছেলে মানিক সরেন, ছেলের বউ সোহাগিনী হাসদা প্রত্যেকে আদিবাসী আন্দোলন কর্মী হিসেবে নিজ নিজ নামে পরিচিত। তবে ভদ্রমহিলার নাম জানা ছিল না বলে তখনও বুঝতে পারিনি বাহা পরবে নিমন্ত্রণের যে চিঠিটা পেয়েছিলাম, সেই চিঠিতে যিনি সই করেছেন, তিনিই সেই বাসন্তী মুর্মু। দেখলাম একপাল ছেলেমেয়েকে খাওয়াতে বসেছেন লাঠি হাতে। লাঠি হাতে বলাটা রূপকার্থে বলছি, কারণ অল্প বয়সী পাল পাল সন্তানের মা হতে গেলে হাতে অদৃশ্য লাঠি রাখা জরুরি, সেটা আমি বাসন্তী মুর্মুকে দেখে জানলাম।
সত্যি বলতে কী, নারীর নানারকম ব্যর্থতা আর সাফল্য দেখেছি আমরা। এ নিয়ে তর্কও বিস্তর। বহুকাল ধরে সেই রকম সফল কোনো নারীকে খুঁজছিলাম, যিনি একই সঙ্গে গোয়াল সাফ করেন এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। রাবড়ি দেবীর কথা মনে পড়ল। খবরের কাগজ থেকে বাবা আর আমি একসঙ্গেই পড়তাম রাবড়ি দেবীর কথা। বাপ-মেয়ে এ নিয়ে কথাও বলতাম। ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হলে স্ত্রীকে বিধায়ক করে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলেন লালু। তখন নিন্দুকেরা উশখুশ করতে লাগলেন। তাদের মনে হলো গোয়াল বাড়ানো (গরুর ঘর পরিস্কার করেন যিনি) এক নারী কীভাবে রাজ্যসভা সামলাবেন। নয় সন্তানের জননী, যার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৭ বছর বয়সে, সেই রাবড়ি দেবী বললেন, ‘আমি মূর্খ হলেও আপনারা সবাই শিক্ষিতজন। আপনারা সাহায্য করবেন।’ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন ওই নারীর কথা শুনে। খুব ভালো লেগে গিয়েছিল ব্যাপারটা। নারীর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য পুরুষের মতো হয়ে ওঠাটা ভালো লাগে না আমার। নারী, তার নারীরূপেই সুন্দর। বৃদ্ধা তার অভিজ্ঞতায় সুন্দর। কৃষাণি তার কৃষকরূপেই সুন্দর। সৌন্দর্যকে ‘জিরো সাইজ’ ফিগারের ধারণায় আবদ্ধ করতে একটুও রাজি নই আমি।
যাই হোক, বাসন্তী মুর্মু আমার চোখ এবং মনোযোগ নিয়ে ফেললেন। দুটি দিন তার বাড়িতে কাটিয়ে বুঝতে পারলাম নিজের পেটের সন্তান দুটি হলেও অনেক সন্তানের মা তিনি। একঝলক তাকে দেখে কীভাবে যেন আমি জেনে গেলাম, এত লোকের মধ্যে তাকেই সম্ভাষণ জানাতে হবে। তিনিই এই আসরের প্রধান। বয়স তার মধ্যগগনে পৌঁছেছে। চুলগুলো কমে এসেছে। মুখে তরুণীর লাবণ্যের বদলে অভিজ্ঞতা আর দায়িত্বের পকস্ফতার ছাপ। ঘরের ভেতর থেকে আসা বিজলিবাতির অল্প আলোয় সাজসজ্জা তেমন বোঝা যায় না। আর সাজ বলতে তো কাজের ভারে কোনোমতে পেঁচিয়ে থাকা শাড়িটা। হাতে কয়েকগাছি চুড়ি ছিল বোধ হয়। আমাকে তিনি বসতে বললেন। ফাঁকা একটা চেয়ারে তাড়াতাড়ি জায়গা করে নিয়ে তার কাজকর্মের ব্যাঘাত না করতে চেষ্টা করলাম। উঠোনে তিন-চারটে বড় ডেকচিতে সবজি, ডাল আর ভাত। উত্তরের নানা জেলা থেকে আদিবাসী ছাত্র-যুব সংগঠনের যে ছেলেমেয়েরা এসেছে পরের দিনের বাহা পরব বা ফুল উৎসবে পারফর্ম করবে বলে, তাদের খানাপিনা তদারকি করছিলেন তিনি।
বাসন্তী মুর্মুকে নিয়ে আরও কথা বলার আগে বাহা পরব সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া যাক। বাহা পরব হচ্ছে সাঁওতাল বা হড়দের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। এটা তাদের প্রাণের উৎসব। বারকোনায় বিগত কয়েক বছর ধরে যে বর্ণাঢ্য বাহা উদযাপিত হয়ে আসছে, তার সামনে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সরেন। উৎসব আয়োজনের কাজকর্মে সবার আগে মানিককে দেখা যায়। রয়েছে মারিও খোকন, শিল্পী, সোহাগিনীসহ আরও অনেকের ভূমিকা। তবে এবার বাহায় গিয়ে মনে হয়েছে এই বাহা পরবের প্রাণভোমরা হলেন বাসন্তী মুর্মু।
বাহা শব্দের বাংলা ফুল। বাহা পরব মানে দাঁড়ায় ফুল উৎসব। ফাল্কগ্দুন মাসের পূর্ণিমা তিথির পর থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এ উৎসব উদযাপন করা হয়। শালগাছে তখন ফুল ফোটে। বাহা পালনের আগে শাল ফুল মাথায় দেওয়া বারণ। শিকারে যাওয়াও বারণ। প্রকৃতিকে নতুন সৃষ্টির জন্য তৈরি হতে অবসর দেওয়া হয় এই সময়ে। বাহা পরবের সঙ্গে ভূমি, পরিবেশ, প্রকৃতির ঋতুচক্রের ধারণা জড়িয়ে আছে। প্রকৃতির কোন সম্পদ কখন ব্যবহার করতে হবে, তার জন্য নির্দেশনা পাওয়া যায় আদিবাসীদের উৎসবগুলো থেকে। ভূমিকে কীভাবে ব্যবহার করলে তার উর্বরতা ঠিক থাকবে সেটিও জানা যায়। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে সম্পদ ব্যবহারের পরিমিতিবোধের ধারণা পাওয়া যায়। সম্পদ ব্যবহারে পরিমিতি এবং সময়জ্ঞান প্রকৃতিকে পুনরায়নের সুযোগ করে দেয়।
বাহা পরবের সময় অর্থাৎ ফাল্কগ্দুন মাসে যখন প্রকৃতিতে নতুন নতুন ফুল, ফল, পাতা আসে। প্রকৃতির সেই সময়কে হড় বা সাঁওতালরা মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে। হড় ভাষায় মেয়েদের এ বয়ঃসন্ধিকালীন সময়কে ‘বাহা কানায়’ বলে। এর আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ফুল ফুটছে’। শালফুল বাহা পরবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, শালফুলকে হড় ভাষায় বলে ‘সারজম বাহা’। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় সিদু-কানু জুলুম আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমবেত হওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে পাতাসমেত ছোট শালের ডাল পাঠিয়েছিলেন। তাদের কাছে শালের ডাল একতার প্রতীক এবং ঐতিহ্যের অংশ।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারকোনা গ্রামে শালবন নেই আর। একদা শালবনের ভেতরে গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন জাতিগুলোর একটি হড়দের আবাস। বাহার অনিবার্য অনুষঙ্গ শালফুল সংগ্রহের জন্য যেতে হয় দূরের বনে। দিনাজপুরের কোথাও কোথাও ছোট ছোট কিছু বন এখনও রয়েছে। সেই সব বন থেকে সংগ্রহ করে আনা ফুলেই সাজে বারকোনা কলম সরেন ও আলমা সরেন মাঠের বাহা পরব। যদিও ঘরোয়াভাবে বাহা উদযাপিত হয়ে আসছে সবসময়ই। বারকোনায় রবীন্দ্রনাথ সরেন-বাসন্তী মুর্মু পরিবারের আয়োজনে এটা বড় করে উদযাপিত হচ্ছে আজকাল। সেই উৎসবে যাওয়ার নিমন্ত্রণের চিঠিটা পেয়েছিলাম বাসন্তী মুর্মুর নামে।
বলছিলাম বাসন্তী মুর্মুর সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রথম সন্ধ্যার কথা। গৃহিণীর সামনে একদল মানবসন্তান, পেছনদিকটা জুড়ে একপাল গো-সন্তান। গো-সন্তানদেরও ঠিক নিয়মে এবং যত্নে রেখেছেন তিনি। হড় বাড়িতে গবাদি পশুর কদর আছে, তা আগে থেকেই জানতাম। তাই বলে বাড়ির একটা দিক পুরোপুরি গরুদের থাকার ঘর! গোচোনা যাওয়ার জন্য পাকা পথ করা হয়েছে। মশা তাড়ানোর জন্য কয়েল জ্বলছে বেশ কয়েকটি। বোঝা গেল তিনি এই সংগঠনের সাংস্কৃতিক দলের কাজকর্ম দেখেন শুধু তাই নয়, গবাদি পশুর দিকেও তার মনোযোগ আছে যথেষ্ট। আদতেই ব্যাপারটা এমন না যে, তিনি সাংগঠনিক কাজ, সামাজিক কাজকর্ম এবং নিজের এনজিওটির দেখভাল করতে গিয়ে ঘরের মধ্যেকার বিরাট সংসারটাকে ছোট করেছেন। বরং বিয়ের কিছুকাল পরে যখন বুঝলেন, স্বামী একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ এবং বৈষয়িক বিষয়ে বেশি সময় দিতে পারবেন না, তখন রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বরং সংসারের হাল নীরবে নিজের হাতে নিয়েছেন। নিজের মহানুভব স্বামীটিকে মহানুভবতার অপরাধে ত্যাজ্য করেননি। স্বামীটিকে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন তার সামাজিক প্রতিজ্ঞাকেও। নিজেও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে কেবল মান্দি এবং খাসিরা মাতৃতান্ত্রিক। হড় সমাজ মাতৃতান্ত্রিক না হলেও পারিবারিক জীবনে নারীর শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে সেখানে।
বাসন্তী মুর্মু কেবল কাজ করছেন তাই নয়। রাতের বেলায় যখন রবিন দার কাছে উত্তরের আদিবাসীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম বাসন্তীদিও কাজের ফাঁকে একটু গল্প করে গেলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি বললেন, যেসব পরিবার চার্চে যায়, তারা ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য পাঠায় না। ভাবলাম, সত্যি তো যেসব ধর্ম খুব বেশি সুশৃঙ্খল জীবনচর্চার কথা বলে, তার অনুসারীদের পক্ষে লৌকিক চর্চা ধরে রাখা একরকম অসম্ভব। বাংলাদেশের সাঁওতালদের অর্ধেকের বেশি মানুষ খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেছে। বাসন্তী মুর্মুর এনজিওর পক্ষ থেকে ঐতিহ্য সচেতনতা এবং নানারকম জীবনদক্ষতার কাজ করা হয়েছে মুশহর আদিবাসীদের এলাকায়। তার পুরো পরিবারটি এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত। আগেই বলেছি, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই কেউ বাদ যায়নি। সবাই এলাকার সব আদিবাসীদের সঙ্গেই কাজ করছেন নিরন্তর। পরিবারকে সমাজের করে তোলা, সমাজকে পরিবারে যুক্ত করার এ এক অনন্য উদাহরণ। এই নারীর গ্রহণ এবং নিয়ন্ত্রণশক্তি সেখানে অনেক বড় নিয়ামক হয়েছে। তিনি পেয়েছেন ‘অনন্যা’ পুরস্কারের স্বীকৃতিও।