সুর্যর মা তাকে চারবেলা খাওয়াতে নাজেহাল হয়ে যায়। অগত্যা স্মার্টফোনই ভরসা মায়ের। পছন্দসই কার্টুন চালিয়ে দিলেই তা হাঁ করে দেখতে বসে যায় সুর্য। মায়েরও হাত চলতে থাকে দ্রুত তাকে খাওয়ানোর জন্য। সেক্ষেত্রে মাও খুশি,বাচ্চাও খুশি। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। আড়াই বছরের সূর্য অন্য কোথাও গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতে চায় না। কারণ বাড়ির ওই পরিবেশে, ওই কার্টুনটাই চাই তার খাবার সময়। তা না হলে জেদ, কান্নাকাটি, শেষে কাঁদতে কাঁদতে বমি, এসব তার নিত্যদিনের উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত দেড় বছর ধরে অতিমারীর জন্য ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে ১৪ বছরের শ্রাবনী ১৬ বছরের কথা। চটপটে সপ্রতিভ মেয়েটি এখন দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় স্মার্টফোনের স্ক্রিনের পর্দায়। ধীরে ধীরে আলস্য গ্রাস করছে তাকে। এমনকি ঠিক করে কথাও বলে না সে কারও সঙ্গে। লেখাপড়ার ইচ্ছেতেও পড়েছে ভাটা।
দুটি ঘটনাই আজকাল শহর ও শহরতলির বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনের খুব চেনা ছবি। বাচ্চাদের মধ্যে টিভি, মোবাইল বা ভিডিও গেমের প্রতি এই যে আসক্তি তৈরি হচ্ছে, তার জন্য অনেকাংশেই দায়ী ভুল পেরেন্টিং।
কী ভাবে তৈরি হয় মোবাইল আসক্তি?
টিভি, মোবাইল গেম বা যে কোনও ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ক্ষরণ হয় এক ধরণের নিউরোট্রান্সমিটার, যার নাম ডোপামিন। এই ডোপামিনের ক্ষরণ আমাদের মনে এক ভাল লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। তার ফলে অতি সহজেই আমরা এই ধরনের এন্টারটেনমেন্ট মিডিয়াম গুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত যতটা কম ডোপামিনের ক্ষরণ হয়।
কীভাবে বাচ্চাদের এই ধরনের আসক্তি থেকে দূরে রাখবেন?
এক. বাচ্চার হাতে কোন পরিস্থিতিতেই মোবাইল ফোন বা ভিডিও গেম তুলে দেবেন না। নিজের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করুন, বাড়ির খুব দরকারি গ্যাজেটের মতন মোবাইল ফোনও একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, বাচ্চার খেলার সামগ্রী নয়। বাড়ির ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ এসব নিয়ে কি ও খেলা করে? নিশ্চয় নয়। মোবাইল ফোনকেও সেভাবে মা বাবারা যদি চিহ্নিত করেন তাহলে বাচ্চারা অবশ্যই বুঝবে ব্যাপারটা। বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে তাদের বোঝানো উচিত টিভি বা মোবাইলের আসক্তির খারাপ ফলগুলো।
দুই. বাচ্চাদের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করুন। আজকাল বেশিরভাগই ছোট পরিবার। তাই বন্ধু ও পরিজনহীন বাড়িতে টিভিকেই তারা পরম বন্ধু করে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা বাবা দুজনেই চাকরি বা অন্য কাজে অনেকটা সময় বাইরে থাকলে বাচ্চার কেয়ারগিভার তাকে টিভির সামনে বসিয়ে নিজের কাজ সারেন। ক্রমে বাচ্চা আসক্ত হয়ে পড়ে টিভিতে।
বাচ্চার জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটির প্ল্যান করুন। আজকাল বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি সেন্টার রয়েছে যারা নাচ, গান, গল্প বলা, মিউজিকাল ইন্স্ট্রুমেন্ট শেখায়। বিকেলবেলাটা বাচ্চাকে সে সবের মধ্যে থাকতে শেখান। তাতে সমবয়সি বাচ্চাদের সাথে সময়ও কাটাতে পারবে, ওদের একাকিত্বও ঘুচবে।
তিন. বাচ্চার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। ছোটোবেলা থেকে রোজ রাত্তিরে শোবার আগে বাচ্চাকে যদি বই থেকে গল্প পড়ে শোনানোর অভ্যাস তৈরি করা হয় তাহলে ওদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতাও বাড়ে। তখন টিভি, মোবাইল বা ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে অনেক সহজেই বাচ্চাকে দূরে রাখা যায়।
চার. মাঝেমাঝে বাচ্চাদের নিয়ে প্লে ডেট তৈরি করুন। ওদের খেলার সাথে নিজেরাও মেতে উঠুন। দেখবেন ওরা অনেক বেশি উপভোগ করছে ওদের শৈশবকে।
পাঁচ. অনেক সময় বিভিন্ন কার্টুন ক্যারেক্টার বা মোবাইল গেমস বাচ্চাদের ভায়োলেন্ট করে তোলে। কার্টুনে মারপিট বা মোবাইল গেমের কার ক্র্যাশিং খেলা বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটায়। তারা অতিরিক্ত হাইপারঅ্যাক্টিভ বা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। তাই লক্ষ্য রাখুন কী ধরণের প্রোগ্রাম বাচ্চারা দেখছে। সেক্ষেত্রে বাচ্চার পাশে বসে ওকে সঠিক ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন।
ছয়. বাচ্চাদের কখনই বড়দের সোপ সিরিয়াল বা ক্রাইম প্যাট্রল জাতীয় প্রোগ্র্যাম দেখতে দেবেন না। আমরা বড়রা অনেক সময়ই এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না, তার ফলে অচিরেই বাচ্চাদের মনের মধ্যে অকারণ জটিলতা, ভয় বা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। নানারকম মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে তারা। শুধু তাই নয়, যে কোনো কাজে মনসংযোগ করতেও তাদের অসুবিধে হয়।
সাত. বাচ্চাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিন সময় মেপে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার বাড়ির এমন একটি জায়গায় রাখুন যাতে তা বড়দের চোখের সামনে থাকে। তাতে বাচ্চারা কী ধরনের বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে নাড়াচাড়া করছে তা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
আট. মা-বাবার একটা সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার ইন্টারনেট বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট সমন্ধে। প্রয়োজনে সিকিউরিটি সিস্টেম আপডেটেড রাখুন।
নয়. বাচ্চার খাওয়ানোর সময় বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনও ধরনের গ্যাজেটের অভ্যাস রাখবেন না। আজকালকার দিনে আপাতভাবে এটা শুনে অসম্ভব মনে হলেও কয়েকদিন অভ্যেস করলেই এটা সহজ হয়ে উঠবে। বরং গল্প বলুন। তাতে বাচ্চা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সম্পর্কে শিখবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে না।উপরে বলা সব কিছুই সম্ভব হবে যদি বাবা-মা সঠিকভাবে সব কিছু প্ল্যান করেন। এর জন্য নিজেদেরকে বাচ্চার সামনে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। মোবাইলে গেম খেলা বা টিভি দেখার অভ্যেস মা বাবার মধ্যে যতটা নিয়ন্ত্রিত হয় ততই উপকৃত হবে সন্তান।নয়. বাচ্চার খাওয়ানোর সময় বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনও ধরনের গ্যাজেটের অভ্যাস রাখবেন না। আজকালকার দিনে আপাতভাবে এটা শুনে অসম্ভব মনে হলেও কয়েকদিন অভ্যেস করলেই এটা সহজ হয়ে উঠবে। বরং গল্প বলুন। তাতে বাচ্চা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সম্পর্কে শিখবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে না।উপরে বলা সব কিছুই সম্ভব হবে যদি বাবা-মা সঠিকভাবে সব কিছু প্ল্যান করেন। এর জন্য নিজেদেরকে বাচ্চার সামনে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। মোবাইলে গেম খেলা বা টিভি দেখার অভ্যেস মা বাবার মধ্যে যতটা নিয়ন্ত্রিত হয় ততই উপকৃত হবে সন্তান।
গৌরী হালদার
প্রধান শিক্ষিকা
কথা একাডেমি কিন্টারগার্ডেন স্কুল।
বরিশাল।