২৮শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ বিকাল ৩:০৮

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা দণ্ডিতদের পরোয়ানা থানায় ফাইলবন্দি

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ শনিবার, ডিসেম্বর ৯, ২০১৭,
  • 492 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

পুরান ঢাকার রাস্তায় নিরীহ পথচারী যুবক বিশ্বজিৎ চন্দ্র দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের বিচার শেষে হাইকোর্টের রায়ও প্রকাশ হয়েছে। এ মামলার পলাতক ফাঁসির আসামি ও যাবজ্জীবন শাস্তি পাওয়া আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় গেছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। কিন্তু সেটা তামিল না হয়ে সংশ্নিষ্ট থানায় ফাইলবন্দিই পড়ে আছে। গত পাঁচ বছরে গ্রেফতার হয়নি পলাতক ১৩ আসামি। পুলিশের খাতায় তারা পলাতক থাকলেও অধিকাংশ প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিশ্বজিতের ক’জন স্বজন হতাশা প্রকাশ করে জানান, তারা গরিব। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ গ্রেফতার করছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাতক আসামিদের রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তারা নিয়মিত পোস্ট দিচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচির ছবি। এসব কারণে সংশ্নিষ্ট থানা পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারে মোটেও তৎপর নয়।

চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানেন, পলাতক বেশিরভাগ আসামি বিদেশে চলে গেছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। বিদেশ গেলেও হত্যা মামলার আসামিদের ফিরিয়ে আনা কিংবা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির তৎপরতাও নেই। নেই আসামিদের গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় মনিটরিং। পলাতক ক’জন আসামির স্থায়ী ঠিকানার থানাগুলোতে যোগাযোগ করেও পাওয়া গেছে একই চিত্র।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক তাজুল ইসলাম জানান, কোনো মামলার রায় হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় চলে যায়। এসব আসামিকে গ্রেফতারের দায়িত্ব থানা পুলিশের। গ্রেফতার না হলে থানায় ওয়ারেন্ট জমা থাকে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এমন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা পুলিশের দায়িত্ব।

বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ চলাকালে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল কর্মী বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং ওই ঘটনায় গ্রেফতার আসামিদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ককটেল নিক্ষেপকারী ভেবে নিরীহ-নির্দোষ ওই যুবকের ওপর হামলা চালানো হয়। গণমাধ্যমে সেই বীভৎস হত্যার ছবি প্রকাশ পেলে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে সর্বস্তরের মানুষ খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানায়। তবে শুরু থেকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘটনায় জড়িত কেউ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নন, তারা অনুপ্রবেশকারী।

ঘটনার এক বছর পর ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়ে রায় দেন। রায়ে রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিয়া, রাজন তালুকদার ও মীর নূরে আলম লিমনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

তবে চলতি বছরের ৬ আগস্ট মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুনানির রায়ে হাইকোর্ট ওই আট আসামির মধ্যে রাজন ও শাকিলের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। সাইফুল ও কাইয়ুমকে খালাস ও অন্য চার আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হয়।

পাশাপাশি নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করা গোলাম মোস্তফা ও এএইচএম কিবরিয়া খালাস পান। অন্য ১১ আসামি ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামি শাকিল, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া নাহিদ, এমদাদ ও শাওন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। হাইকোর্ট থেকে খালাস পাওয়া চারজন এরই মধ্যে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আর দুই আদালতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা রাজন, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া লিমন, ইউনুস, তমাল, আলাউদ্দিন, তাহসিন, ইমরান, আজিজুর, আল-আমিন, রফিকুল, পাভেল, কামরুল ও মোশারফকে গত পাঁচ বছরেও ধরতে পারেনি পুলিশ।

পলাতকরাকে কোথায়: মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রাজন পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও তাকে মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কিছু সময় কলকাতা থাকলেও সে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে বলে তার ক’জন বন্ধু নিশ্চিত করেছেন। এক মাস আগে ফাঁসির এই আসামিকে শাহবাগে বন্ধুদের সঙ্গে প্রকাশ্যে আড্ডা দিতে দেখা গেছে।

মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া মীর নূরে আলম লিমন ঢাকার মিরপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ইউনুস আলী ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তাকে মাঝে মধ্যে মতিঝিল এলাকায় দেখা যায় বলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক ক’জন ছাত্রনেতা জানিয়েছেন।

পলাতক ক’জন আসামির স্বজন ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আল-আমিন কলকাতায় অবস্থান করছে। তমাল অবস্থান করছেন সিঙ্গাপুরে। তাহসিন দুবাইয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছর পর্যন্ত যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া কামরুল কক্সবাজারে হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি ঢাকায় অবস্থানের কথা জানা গেলেও তার একজন বন্ধু গত বৃহস্পতিবার জানান, সে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছে।

পলাতক রফিকুল, ইমরান, পাভেল ও মোশাররফ ঢাকাতেই রয়েছে। আজিজুর রহমান খুলনার খানজাহান আলী এলাকায় গ্রামের বাড়িতে থাকে। আলাউদ্দিন গাজীপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত বলে জানা গেছে।

গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে থানা পুলিশ যা বলল: ফাঁসির আসামি রাজন তালুকদারের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার কেশবপুরে। কলমাকান্দা থানার ওসি মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ ধরনের একজন আসামির বাড়ি তার এলাকায় বলে শুনেছেন। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে কি-না, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। পরে অবশ্য জানান, ওই আসামি সম্ভবত কলকাতায় আছে।

লিমনের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। ওই থানার ওসি আমিরুজ্জামান জানান, দণ্ড পাওয়া ওই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও সে এলাকায় আসে না। তাকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে।

ইউনুস আলীর বাড়ি মাগুরা সদরের গাংনালিয়া এলাকায়। জানতে চাইলে সদর থানার ওসি ইলিয়াস হোসেন জানান, এ ধরনের একজন আসামির গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয়। অন্য দুই আসামি মনিরুল হক পাভেল ও মোশারফ হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব থানার ওসি মোখলেসুর রহমান জানান, থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে কি-না, সেটি তিনি জানেন না। একজন উপপরিদর্শক পরোয়ানার বিষয়টি দেখেন।

নিহত বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম চন্দ্র দাস জানান, আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে না। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, কারাগারে যারা রয়েছে তারাও ছাড়া পেয়ে যেতে পারে।

সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকারী এসআই জাহিদুল হক ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মাকসুদুর রহমানের কোনো গাফিলতি ছিল কি-না, তা তদন্ত করে আইজিপি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। এই আদেশ ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে সময়ে সময়ে আদালতে জানাতে বলা হয়।

জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আদালতের নির্দেশে তিনি পুলিশ সদরদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ওই চিঠির জবাব আসেনি। ফলে ওই দু’জনের গাফিলতি ছিল কি-না, তা এখনও জানা যায়নি।

সূত্র: সমকাল 

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »