॥ অপূর্ব গৌতম ॥
——————————————–১১৭ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
মাঠের কাজে ভগ্নিপতি আঃ হামিদ মোল্লাকে সাহায্য না করে বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে ‘জলের কল’ চালানোর অপরাধে বেধড়ক কিল-ঘুষি-চড়-থাপ্পর খেতে হয়েছে আরজ আলী মাতুব্বরকে। দুই হাত ধরে শিশু আরজ আলীকে আছাড় দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি হামিদ মোল্লা। তার বানানো ‘জলের কল’ ভেঙেচুরে চুরমার করার পরও শরীরের ক্রোধ কমেনি, ঘরে গিয়ে মাতুব্বরের জমানো বই ও ছবিগুলো চুলার মধ্যে দিয়া পোড়াইয়া ফেলিল সেজ বোনের স্বামী হামিদ মোল্লা। রাগে-ক্ষোভে-দু:খে আরজ আলী বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে ‘হয় পড়ব, নয় মরব’ এমন কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তারিখটি ছিল ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ৩রা চৈত্র। এই দিনই আরজ আলী একটা ময়লা জামা ও ছেঁড়া লুঙ্গি পড়ে চৌদ্দ আনা পয়সা নিয়ে অভুক্ত অবস্থায় বেলা ১২টার দিকে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেড় হন। বানারীপাড়ার বাকপুর গ্রামে এক বাড়িতে অবস্থানের পরের দিন মানুষের কথামত মাগুরা (বর্তমানে শর্ষীণা) রওয়ানা হন। বাড়ির অভিভাবকের অনুমতি লাগবে – এই কথা বলে তাকে আর ভর্তি করেনি মাগুরা কর্তৃপক্ষ। পরেরদিন আবার ১৯ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে লামচরীর বাড়িতে উপস্থিত। আরজ আলী ভাবছিল তার মা-বোন-ভগ্নিপতি তাকে খুব গালাগাল করবে কিন্তু ছেলেকে ফিরে পেয়ে মায়ের আর আনন্দ ধরে না। গত পরশু থেকে অনাহার আর অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছে। জামাতাকে অনেক গালমন্দ, ভর্ৎসনা করেছে। ঐ চৈত্র মাসেই ভগ্নিপতি আঃ হামিদ মোল্লা পুলিশের ‘কনষ্টবলে’ নাম লেখাইয়া বৈশাখ মাসে ৬ মাসের জন্য প্রশিক্ষণে গেলে আরজ আলী মাতুব্বর হাফ ছেড়ে বাঁচে।
মরতে হলেও চেষ্টা করতে হবে আবার পড়তে হলেও চেষ্টা করতে হবে এমন ভাবনায় আরজ আলী ঠিক করলেন পড়ার চেয়ে মরার চেষ্টা অনেক কঠিন তাই পড়ার চেষ্টা করি, যদি না পাড়ি তবেই মরব। কি পড়ব? এমন ভাবনায় সিদ্ধান্ত নিলেন, যা পাব তাই পড়ব, একা একা পড়ব। শুরু হল আরজ আলীর পড়ার যাত্রা। তিনি পড়তে পড়তে জেনেছেন বুঝেছেন এবং যেখানে যেখানে তার খটকা লেগেছে সেখানেই তিন নোট আকারে প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থা তার মনে ব্যাপকভাবে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি সব সময় সত্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “কেহ কেহ মনে করেন যে, ঈশ্বর সদয়ও নহেন এবং নির্দয়ও নহেন। তিনি নিরাকার, নির্বিকার ও অনির্বচনীয় এক সত্তা। যদি তাহা নাই হয়, তবে পৃথিবীতে শিশু মৃত্যু, অপমৃত্যু, এবং ঝড়-বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদিতে প্রাণহানিজনক ঘটনাগুলির জন্য তিনিই কি দায়ী নহেন?
অন্য এক জায়গায় তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবাই নপুংসক। মকরমও তাহাই ছিল ‘লানত’ বা অভিশাপ প্রাপ্তির সময়ও মকরম একাই ছিল এবং নপুংসক ছিল। তৎপর তাহার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন? শুধু ইহাই নহে, শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে, প্রথমত তাহার ক্লীবত্ব ঘুঁচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনাস্তে একটি স্ত্রী-শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানেরও স্ত্রী আছে? আর না থাকিলেই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?
বিজ্ঞান এবং যুক্তি তাকে খুব টানতো। এই দু’য়ের বাইরে তার চিন্তাশক্তি রহিত হয়ে যেতো। পাড়াপড়শি এবং বন্ধুরা তাকে নাখোদা (নাস্তিক) বলে প্রচার করতে লাগলো। তার এই দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ১৩৫৮ সালে বরিশালের তৎকালীন তবলীগ জামাতের আমীর এফ. করিম সাহেব আরজ আলী মাতুব্বরের সাথে তর্ক যুদ্ধে হেরে গিয়ে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে তাকে ফৌজদারী মোকদ্দমায় সোপর্দ করে। ঐ মামলায় যে সব যুক্তি তর্ক লিখিত আকারে আদালতে উপস্থাপিত হয়েছিল তাহাই আরজ আলী মাতুব্বরের বিখ্যাত বই ‘সত্যের সন্ধানে’।
১৩০৭ সালের ৩ পৌষ (আরজ আলী মাতুব্বরের মায়ের কথিত মতে) আরজ আলীর জন্ম আমাদের এই প্রিয় শহর বরিশাল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে লামচরী গ্রামে। তাঁর ১১৭ তম জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধা অবিরাম।
বরিশাল : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭