সৌপ্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা: দুর্গা কালীসহ ৩৩ কোটি দেবদেবী রয়েছেন। যারা জনপ্রিয় তাদের রূপ মোটামুটি হিন্দুদের চেনা। ভারত মাতাকে কেমন দেখতে? জানা নেই। হাওড়া , কলকাতা ঘুরলে খান দশেক ‘ভারত মাতা’ গলি রয়েছে। অনেকে দ্বিভুজা তেরঙ্গা হাতে সিংহবাহিনী দেবীর মূর্তিকে ভারত মাতা রূপে পূজা করেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারত মাতার রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। গেরুয়া বসনা চতুর্ভুজা দেবী ভারতমাতা।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পিত এমন ভারত মাতার রূপের প্রমান মিলছে শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসুর তথ্যচিত্র। ৪৪ মিনিটের তথ্যচিত্রটি ২ বছর ধরে রিসার্চ করে বানিয়েছেন সত্তোর্ধ্ব প্রাক্তণ ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেন, “নন্দলালকে চিনতে আমি ২ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। যত গভীরে গিয়েছি তত ভালো লেগেছে। এই বয়সেও তাই দৌড়াদৌড়ি কিছু মনেই হয়নি।”

সম্প্রতি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টে। সেখানেই মিলেছে অবন ঠাকুরের কল্পনায় ভারত মাতার রূপ। তথ্য চিত্র অনুযায়ী সেই সময় লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর বিরুদ্ধে তখন বাংলা জুড়ে চলছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন। অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ভারত মাতার ছবি। ভারত মাতার চার হাত। চার হাতে ধান, রুদ্রাক্ষ মালা, পাট এবং একটি কাঠের বাদ্যযন্ত্র। গেরুয়া বসনে তার বৈরাগী রূপ এক কথায় অসাধারণ। নন্দলাল বসুর আঁকার উপর অবনীন্দ্রনাথের প্রভাব বোঝাতে গিয়ে এই চিত্রটি ব্যবহার করেছেন পরিচালক।

চিত্রকলার প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে এফ.এ. পরীক্ষায় পর পর দুবার ফেল করেন। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলিকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। সেখান থেকেই তিনি বিদেশী আঁকার ধরন ছেরে ভারতীয় শিল্পকলায় মন দেন। পরে এখানকার ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন।

১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২২ সালে বিশ্বভারতীর কলা ভবনের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৬ সালে ললিত কলা একাডেমির দ্বিতীয় ফেলো নির্বাচিত হন।

তথ্যচিত্র অনুযায়ী, নন্দলাল বসুর জন্ম খড়গপুরের মুঙ্গেরে (বিহার), ৩রা ডিসেম্বর, ১৮৮২ সালে । বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র বসু। মাতার নাম ক্ষেত্রমণি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দেব-দেবীর মূর্তি সহ পুতুল তৈরি করতেন।পরে কর্মজীবনের শুরুতে পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। প্রায় একই সময়ে পুরী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন এবং কোণারকের সূর্য মন্দির তাঁকে প্রভাবিত করে।

১৯২১ সালে তিনি বাঘ গুহার নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতার হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী বইটির অঙ্গসজ্জা করেন এবং ঠাকুর বাড়ির চিত্রকলার তালিকা তৈরিতেও সাহায্য করেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫-৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের ছবিগুলিও তাঁর আঁকা। তাঁর বিখ্যাত চিত্রগুলির মধ্যে অন্নপূর্ণা, সতী, দার্জিলিং প্রভৃতি উল্লেখ্য।

মহান চিত্রকর ১৯৬৬ সালের ১৬ই এপ্রিল ৭৯ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে পরলোকগমন করেন।