সৌভিক রাতুল বসু
জাদুঘর দেখতে গিয়ে পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহকারক কর্নেল Colin Mackenzie নামটা দেখার পর বিদ্যুত চমকের মত একটি নাম মনে পড়ে গেল —- জেনারেল Charles Stuart ।
গতকাল ভারতীয় জাদুঘরে গিয়েছিলাম প্রায় ৩০ বছর পরে । শেষবার যখন গিয়েছিলাম তখন আমার বয়স বড়জোর বছর দশেক , জাদুঘরের জাদু উপলব্ধি করার বয়স তখনও হয় নি ।
আজ থেকে ২০০ বছর পিছনের উড স্ট্রিট । কোনও এক বাড়ী থেকে কলকাতার রাজপথে প্রকাশ্যে গামছা কাঁধে শুদ্ধ সংস্কৃতে স্তব করতে করতে প্রতিদিন গঙ্গাস্নানে যান এক সাহেব । ‘ Quite a character ‘ — মন্তব্য করেছেন তৎকালীন প্রধান সেনাপতির স্ত্রী Lady Nugent । ‘ An Idol – stealer ‘ বা মূর্তি চোর বলেছেন জনৈক মিশনারি ।
যদিও মিশনারিরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন মূর্তি -চোর বলে । তবে Epigraphia Indica তে
Dr. L.D.Barnett লিখেছেন , “ ভারতীয় হিন্দু রীতিপদ্ধতি এবং মূর্তি
ইত্যাদির প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং পুরাতাত্ত্বিক বস্তু সংগ্রহের ব্যাপারে
তাঁর অনৈতিক পদ্ধতি গ্রহন , তাঁর এই বদনামের কারণ । “
কিন্তু প্রশ্ন হল , ভারতবর্ষে এত লোভনীয় বস্তু থাকতে Stuart সাহেব পাথরের মূর্তি কিংবা তালপাতার পুঁথিকেই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে নিলেন কেন ? পয়সার জন্য তো নয় । তিনি তো সব দান করেছিলেন ।
Stuart সাহেব ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব করেছেন দীর্ঘকাল । তারপর সাগর থেকে ওড়িশার বহরমপুর হয়ে কলকাতায় । সাগরে থাকাকালীন এক হিন্দু রমনীকে বিয়ে করে নিজ অর্থেই একটি মন্দির গড়েন । ওড়িশায় থাকতেই তিনি নিয়মিত মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন । এরপর চলে এলেন সস্ত্রীক কলকাতায় । এখানে রোজ পায়ে হেঁটে গঙ্গাস্নানে যেতেন , পুজো দিতেন ।
এরপর বাড়ি এসে ঢুকতেন তাঁর মিউজিয়মে । মিউজিয়াম মানে Stuart এর গোটা বাড়িটাই তখন মিউজিয়াম । ভারতীয় ছবি , মূর্তি , পুঁথিপত্র , ঢাল-তরোয়াল , পোশাক – অলংকার সব কিছুই আছে সেখানে । কৌতুহলি দর্শকদের Stuart সাহেব নিজে ঘুরিয়ে দেখাতেন সব ।
শুধু মিউজিয়ম গড়লেই তো লোকে উন্মাদ হয় না । সংস্কৃত বললেও না । তা হলে জোন্স , উইলসন সাহেবদেরও পাগল বলত সাধারণ ইংরেজরা । আসলে Stuart এর উন্মাদ অপবাদের ছিল অন্য কারণ । Stuart ছিলেন হিন্দু , কেবল গঙ্গাস্নান বা মন্দিরে পুজো দিতেন বলে নয় বা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে নয় । Stuart এর অপরাধ ছিল যে তিনি বাস্তবিকই হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন । তিনি এমন উৎসাহভরে এ দেশের ভাষা , রীতিনীতি চর্চা করেছিলেন এবং হিন্দুধর্মের প্রতি এমন সহানুভূতিশীল ছিলেন যে সবাই তাঁকে বলত হিন্দু Stuart ।
স্বজাতির ব্যঙ্গ এবং নেটিভদের ভালোবাসার মধ্যে বৃদ্ধ Stuart চলে গেলেন ৩১শে মার্চ , ১৮২৮ । ঘটনাচক্রে এমন হল যে শুধু ভারত নয় , ইংল্যাণ্ডও ভুলতে পারল না তাঁকে । কারণ ইংল্যান্ডের সংস্কৃত ভান্ডারে Stuart রেখে গিয়েছেন একরাশ অমূল্য সম্পদ । এই খবরটিও জানিয়েছিলেন একজন ভারতীয় — রমাপ্রসাদ চন্দ । ১৯৩৪ সালে রমাপ্রসাদ বাবু লন্ডনে গিয়েছিলেন Anthropological Congress এ যোগদান করতে । ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ভাস্কর্য ঘাঁটতে গিয়ে তিনি পুনরাবিস্কার করলেন Stuart সাহেবকে ।
যদিও সংগ্রহটি পরিচিত ছিল ’ ব্রিজ কালেকশন ’ নামে কিন্তু catalogue ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায় যে এর মালিক আদপেই T.W.Bridge নয় , আসলে General Stuart । ১৮৩০ সালে নিলামে বিক্রি হয়েছিল এগুলো । বহরমপুরে ( ১৮২৩ ) থাকার সময়ই Stuart এই সংগ্রহটির উল্লেখ করে গিয়েছেন তাঁর উইলে । তিনি উইলে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর পুরাতত্ত্বের সংগ্রহটি যেন ৩০,০০০ টাকা ইনসিওর করে লন্ডনে পাঠানো হয় । তা ছাড়া আরও লিখেছিলেন যে লন্ডনের বন্ড স্ট্রীটের মিঃ জন নামে এক পুস্তক- বিক্রেতার কাছে ওনার বিরাট পুঁথির এবং ভারতীয় পুরাবস্তুর সংগ্রহ রয়েছে । সেগুলো যেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দান করা হয় ।
পুঁথিগুলোর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি । মিঃ ব্রিজ কিনেছিলেন ভাস্কর্য নিদর্শনগুলো । ১৮৭২ সালে ব্রিজের কন্যারা আবার নিলামে তুলেছিলেন এই সংগ্রহ । খরিদ্দারের অভাবে মেয়েরা পিতার নামে দান করে দিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে । তার নাম ‘ ব্রিজ কালেকশন ’ যা আদপে General Stuart এর সংগ্রহ । General Stuart এর অধিকাংশ সংগ্রহ করেছিলেন অর্থ , চাতুর্য , শক্তি সমস্ত কিছুর বিনিময়ে । কিন্তু কেন ?
South Park Street Cemetery তে Stuart এর সমাধি -মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল হিন্দু মন্দিরের গড়নে তাতে হিন্দু দেবদেবী , পৃথ্বীদেবী , মকরবাহিনী গঙ্গার অলংকরন । জীবনের পরম সত্যটাকে মৃত্যুর পরেও যাতে কেউ মিথ্যে না করে দিতে পারে , বিশেষত মিশনারিরা , তার জন্যই Stuart এর এই প্রচেষ্টা । যে চোর চুরি করা দ্রব্যও এমন সদম্ভে প্রকাশ্যে ঘোষনা করে যেতে পারেন , তিনি তো চোর নন ।
আসলে Stuart সাহেব তাঁর সমগ্র জীবন দিয়ে ভারতবর্ষ আর হিন্দুধর্মকে পরিচিত করাতে চেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে । Stuart লিখছেন , “ I allude to those children of the East , the Hindus , a people whose religio- philosophy and wisdom are everyday being more and more revived . Looking back to the earliest days of the history of the known world , we find that the first linguistic records belong to the people under consideration , and date back to that far -distant cycle known as Aryan civilization . Beyond history we cannot go ; but the sculptures , monuments and cave temples of India , all point to a time so far beyond the scant history at our disposal , that in the examination of such matters our ( Western Civilization ) greatest knowledge is dwarfed into infinite nothingness — our age and era are but the swaddling clothes of the child ; our manhood that of the infant in the arms of the eternity of MAHAKAL “ । বিশ্বখ্যাত হস্তরেখাবিদ কিরোও ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন আর বিশালত্ব বর্ননা করতে গিয়ে এই অংশটুকু নিয়েছিলেন ।
অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ সন্তান General Charles Stuart ভারতীয় হিন্দু সভ্যতাকে জগতের কাছে তুলে ধরার জন্য যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে তাঁকে ‘ মহান ’ বললেও বোধহয় কম বলা হয় ।