২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ রাত ৪:২৭

শাঁখারি কার্ত্তিকের ‘বাড়ি’ বাঁচানোই দায়

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ সোমবার, জানুয়ারি ২১, ২০১৯,
  • 305 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

শাঁখারি কার্ত্তিক চন্দ্র সেন। বাড়ি ডেফলচড়া শাঁখারিপাড়া। পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নে এ গ্রাম; চলনবিলের ঠিক দক্ষিণ ধারে। শাঁখা বিক্রি করেই সংসার চালাতে হয় কার্ত্তিককে। কিন্তু এখন ব্যবসা তার মাথায়ই নেই। বাড়িতে বসবাস করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের প্রভাবশালীরা তাকে তুলে দিতে চাইছে। ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যানও তার কথা কানে তুলছেন না। কার্ত্তিকের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তিনি তার ব্যবসার কথা বলবেন, নাকি বাড়ি বাঁচানোর কথা বলবেন- তা ভেবে পাচ্ছিলেন না।

৩৬ ঘর শাঁখারি নিয়ে ডেফলচড়া গ্রাম। কার্ত্তিক সেন তাদেরই একজন। কিন্তু তিনি যেন এই গ্রামের ‘বাসিন্দা’ হয়ে উঠতে পারছেন না। কারণ একটাই- তিনি থাকেন খাস জায়গায়। চার শতক জায়গার ওপর শোলার বেড়ার ছোট্ট একটা ঘর। ওপরে বাঁশের চাটাই। নীল পলিথিনে মোড়ানো। বারান্দার একপাশে রান্নার চুলা। একটু বৃষ্টিতেই ঘরে জল ঢোকে। শীতে ঢোকে ঠান্ডা বাতাস। ঘরের সামনে একচিলতে উঠান। এই-ই কার্ত্তিকের বাড়ি। এই এক ঘরেই স্ত্রী পূর্ণিমা, দুই ছেলে মিহির ও সবুজকে নিয়ে মাথা গুঁজে থাকেন তিনি। ছেলেরা বড় হয়েছে, তবু আলাদা থাকতে দেওয়ার সুযোগ নেই।

এটা কার্ত্তিকের বাবার ভিটা নয়। তাকে এখানে বসিয়েছিলেন তার কাকিমা। ডেফলচড়া মৌজার এ বাড়িটির দাগ নম্বর-১৭১। ২১-২২ বছর এই খাসজমিতেই কার্ত্তিকের বসবাস। শত চেষ্টা করেও জায়গাটা নিজের নামে রেজিস্ট্রি করতে পারেননি। অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। বারবার উপজেলা ভূমি অফিসে গেছেন। কিন্তু সব চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের ক’জন প্রভাবশালী। এই একটি মাত্র ঘরেও বিদ্যুতের তার লাগাতে দেননি তারা।

আমরা তিন-চারজন সবেমাত্র কার্ত্তিক সেনের বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন গ্রামের পাঁচ-সাতজন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের জিজ্ঞাসা- আপনারা কারা? এ বাড়িতে বিদ্যুতের মিটার লাগানো যাবে না।

বলার চেষ্টা করলাম, আমরা বিদ্যুতের লোক নই। আমরা শুধু কার্ত্তিক বাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

এবার তাদের গলার স্বর চড়া। মধ্যবয়সী মোটাসোটা একজন বললেন- আমি রাজকুমার সেন। এ গ্রামের প্রধান। আমার জায়গায় আমি তাকে থাকতে দিয়েছি। তার সঙ্গে কোনো কথা বলা যাবে না। মিটার লাগান আর যা-ই করেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর রাজকুমার আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘ও রকম কত সাংবাদিক লুঙ্গির ট্যামোরে গুঁজে রাখি।’ এবার তাড়াশের সমকাল প্রতিনিধি আতিকুল ইসলাম বুলবুল ও আরেক সাংবাদিক আবদুস সালামের আঁতে ঘা লাগল। তারা প্রতিবাদ করলেন। বেঁধে গেল হাউকাউ। অনেক কষ্টে বোঝানো গেল- আমরা কার্ত্তিকের সঙ্গে শুধু শাঁখা তৈরি নিয়ে কথা বলতে এসেছি। কথা শেষ হলেই চলে যাব। এবার তারা কিছুটা শান্ত হলেন। নানা কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। আমরা ফিরলাম কার্ত্তিকের জীবনকথায়। তার কারুকার্যময় শাঁখা বানানো আর বিক্রির গল্পে।

কার্ত্তিক জানালেন, তারা শাঁখায় নকশা করে বিক্রি করেন। শঙ্খ আসে শ্রীলংকা থেকে ঢাকা, খুলনায়। মহাজনরা সেখান থেকে এনে শঙ্খ কেটে জোড়া জোড়া বিক্রি করেন। তারা নেন এখানকার মহাজনের কাছ থেকে। কখনও ২৫ জোড়া, কখনও ৫০। ভালোগুলো কিনতে হয় ২০০-৩০০ টাকা জোড়া। খারাপগুলো ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। এ রকম ‘কাঁচা’ শাঁখা কিনে তার নকশা করেন। সাদামাটা নকশার হলে দিনে ২০টা পর্যন্ত শাঁখার ফিনিশিং দেওয়া যায়। স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো বা পাথর লাগানোর জন্য যেসব শাঁখা, সেগুলো দিনে দু-তিনটার বেশি বানানো যায় না। শাঁখাভেদে দামেও পার্থক্য। সাধারণগুলো বিক্রি করেন ৩০০-৪০০ টাকা জোড়া। নকশাদারগুলো এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বিক্রি করতে যান অনেক দূরে। চাটমোহর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, তাড়াশ, বোনারিনগর ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়ার হিন্দু গ্রামগুলোতে। কোনো দিন পাঁচ জোড়া, কোনো দিন সাত জোড়া বিক্রি হয়। লাভ থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

কার্ত্তিকের বয়স বর্তমানে ৫৮। ৩০ বছর ধরে শাঁখার ব্যবসা করছেন। এ ছাড়া তিনি অন্য কাজ জানেনও না, করেনও না। ছোট ছেলেকে নিজের কাজ শেখাচ্ছেন। বড়টা আরএফএলের দরজার ডিজাইন করে। এ দিয়েই চলছে সংসার। কিন্তু বড় অশান্তিতে আছেন বলে জানালেন তিনি। দু-চার দিন পরপর গ্রামের লোকজন এসে বাড়ি থেকে তুলে দিতে চায়। ঘরটা মেরামত পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না।

কার্ত্তিক আরও জানালেন, গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, অর্থাৎ ১০-১৫ দিন আগে রাজকুমারের কাছে গিয়েছিলেন। বিদ্যুতের মিটার লাগানোর ‘অনুমতি’ চেয়েছেন। জবাবে রাজকুমার বলেছেন, ‘আমি আর কিছু বলব না। বড়জন আসুক। সে যা বলে তা-ই হবে।’ কিছুক্ষণ পর বড় ভাই বিজয় সেন এলেন। বললেন, ‘মিটারের নাম কেটে হয় আমার নামে, না হয় রাধিকার নামে করে আনো। তারপর মিটার লাগবে।’ এর কিছু পর রাধিকার ছেলে রাজীব এসে বলে, ‘কোনো কিছু বুঝি না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।’ বিজয়-রাজকুমাররা ডেকে এও বলেছে- এখান থেকে এক বছরের মধ্যে চলে যেতে হবে। স্ট্যাম্পের ওপর লিখিত দিতে হবে, ‘ আমি এক বছর পর চলে যাব।’

আপনার ওপর এত জোর-জুলুম কেন? গ্রামের মানুষকে জানান না? কার্ত্তিকের উত্তর, ‘জানায়্যা লাভ নাই। রাজকুমাররা গ্রামের প্রধান। তাগোর ওপর দিয়্যা কেউ কথা কয় না। তারা অনেক খাস জায়গা খাচ্ছে। এবার আমার বাড়ির উপুর চোখ পড়ছে।’

-চেয়ারম্যানকে জানাননি?

-জানাইছি। কোনো লাভ নাই। সেও তাদের পক্ষে। ছেলেকে পাঠাইছিলাম। চেয়ারম্যান বলছে- ওয়াপদার বাঁধে গিয়া বাড়ি কর। আর কার কাছে যাব? কারও কাছে যায়্যা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।

কার্ত্তিকের অভিযোগ সম্পর্কে হান্ডিয়াল ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। বলেন- আমাকে মৌখিকভাবে বলেছে, কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও আমি ওই গ্রামের মেম্বার দাদাকে বলেছি, প্রধানদের ডেকেছি। কিন্তু পরে আর কোনো পক্ষই আসেনি।

-আপনি ভূমিহীন কার্ত্তিককে ওয়াপদার বাঁধে চলে যেতে বলেছেন। অথচ রাজকুমাররা নাকি অনেক খাস জায়গা দখল করে খাচ্ছে। কার্ত্তিকের বাড়িটাও নেওয়ার চেষ্টা করছে।

চেয়ারম্যানের উত্তর, ‘আমি তাদের ওয়াপদা বাঁধে যেতে বলিনি। আর আমি সব সময় ভূমিহীনদের পক্ষে। তাদের অবশ্যই সহযোগিতা করব। উনি কাগজপত্র নিয়ে আমার কাছে আসুক। সবকিছু দেখে নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেব।’ তবে তিনি এও বলছেন, রাজকুমাররা কী করেছে, তা তিনি জানেন না। ”কপি ”সমকাল”

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »