অভিযুক্ত ওসিকে প্রত্যাহার করা হলেও বহালতবিয়তে দুই দারোগা *সংখ্যালঘু পরিবার দুটিতে থামছে না কাঁন্না*আ’লীগ নেতাসহ স্থানীয়দের ক্ষোভ প্রকাশ
খুলনা (বটিয়াঘাটা) সংবাদদাতা: খুলনার বটিয়াঘাটা থানার ওসি ও দুই দারোগার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ছাত্র ও এক কৃষককে পুলিশ তুলে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছে। নির্যাতিতদের মধ্যে একজন দরিদ্র পরিবারের কলেজ ছাত্র এবং গরীব কৃষক। তাদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল পুলিশের এমন অভিযোগও উঠেছে। ওই দুই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়ার এক রাত ও একদিন পর বিষয়টি স্বীকার করে থানা পুলিশ। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হলে সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পুলিশ নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করছে কিন্তু কারাগারে গিয়ে দেখা গেছে তাদের মাথার চুল উপড়ে ফেলা হয়েছে। প্রসবে বের হচ্ছে তরতাজা রক্ত। এঘটনায় আ’লীগের নেতৃবৃন্দসহ স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রুত দোষি পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন স্থানীয় এক ইউপি মেম্বারের যোগসাজসে পুলিশ এই অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে।
জানা যায়, প্রায় চার মাস আগে মৃত এক অজ্ঞাত নারীর দেহ উদ্ধার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করে জেলহাজতে প্রেরণ এবং পরবর্তীতে রিমান্ডে আনা হয়। এ ঘটনায় বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের সুখদাড়া গ্রামে নিরিহ মানুষের মাঝে আতংক ও চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন সুখদাড়া গ্রামের গৌরপদ মন্ডলের
ছেলে এক সন্তানের জনক উত্তম মন্ডল (৩৮) স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সদস্য
এবং একই গ্রামের সুকুমার সরকারের ছেলে আনন্দ সরকার সুরখালী ইউনিয়ন
ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
সরেজমিন যেয়ে নির্যাতিত ব্যক্তির স্বজন ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানাগেছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ভুক্তভোগী পরিবারের সাথে সাক্ষাত করে সান্তনা
দিয়েছেন। শনিবার ওই গ্রামে উত্তম মন্ডলের বাড়িতে পৌঁছালে আতংকিত গ্রামবাসি
ঘিরে ধরেন। সাংবাদিক পরিচয় শুনে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন উত্তমের মা লক্ষী রাণী
মন্ডল, স্ত্রী স্মৃতি মন্ডল ও একমাত্র কন্যা জুঁই মন্ডল।
বিলাপ করে উত্তম মন্ডলের মা লক্ষী রাণী বলেন, ‘রাতের আধারে আমার বাবারে
টাইনে ধইরে ওরা ঘর থেকে নিয়্যা গেছে। এক গ্লাস জল খাইতে চালিও খাতি দেয়নি।
জিজ্ঞাসা করছি আপনারা কারা, আমার বাবারে কোথায় নিয়্যা যান। আমি পা জড়াইয়ে
ধরি, আমারে লাথি মেরে ফেলে দেয়, অকেথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। উত্তমের বাবা
গৌরপদ মন্ডল বলেন, ‘আমরা কয়দিন আগেও নৌকার কাজ করছি। এখন নৌকার সরকার
তারপরও এমন নির্যাতন, মিথ্যা মামলা। আমরা কী এখানে থাকতে পারবো না। ২০০১
সালের পরও আমরা নির্যাতনে শিকার হইছি। এখন হচ্ছি। আমরা যাব কোথায়।’
কান্না জড়িত কণ্ঠে উত্তমের স্ত্রী স্মৃতি মন্ডল বলেন, মেয়েডা একটু কিছু
খাইছে না। স্কুলে যায়। ওর বাবারে না পাইলে ও কিছু করবে না। আমি এখন কী
করবো। আমার স্বামীর পুলিশ যে নির্যাতন করছে তা সহ্য করা যাচ্ছে না। আমরা এ
ঘটনার বিচার চাই।
উত্তম মন্ডলের বাড়ির ১-২ কিলোমিটার দুরে কলেজ ছাত্র আনন্দ সরকারের বাড়ি।
বিকাল ৩টার দিকে সেখানে পৌঁছলেও একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আতংকের মাঝেও
ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ।
আনন্দের বাবা সুকুমার সরকার ও মা সুষমা সরকারের কাঁন্না কোনভাবেই থামছে না।
ছেলেকে নির্যাতনের বর্ণনা করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। মা সুষমা বলেন,
যেই ছেলের গায়ে নখের টোকা দেইনি; তারেও ওরা এভাবে কেমনে নির্যাতন করতে
পারলো। আমার ছেলে কী অপরাধ করছে। আমি এর বিচার চাই। স্থানীয় বাসিন্দা পরিমল
মন্ডল, প্রকাশ চন্দ্র মন্ডল, গোপাল অধিকারী বলেন, বিএনপি’র সাবেক এক নেতা
ইউপি মেম্বার এসব ঘটনার মূলহোতা।
এদিকে ওসি মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে পিএসআই শেখ আহম্মদ কবির সঙ্গীয় এএসআই
জাহিদ এর নির্যাতনে উত্তম ও আনন্দ ভবিষতে প্রতিবন্দ্বী হওয়ার উপক্রম হয়েছে
বলে পরিবারের পক্ষ থেকে আশংকা করছে। কারাগারে দেখা করতে গেলে তাদের উপর
অমানসিক নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। এ ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে
গ্রামবাসীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে ঘটনার জের ধরে ওসি মাহাবুবুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অন্যরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান মিজান বলেন, গ্রেপ্তারের পর ওই দুজনকে এমন নির্যাতন চালানো
হয়েছে, তা বর্ণনা করা যায় না। তাদের বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে মধ্যযুগীয়
কায়দায় নির্যাতন করে। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানও এ নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি।
তাদের মাথার চুলও উপরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন তারা কারাগারের
হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। প্র¯্রাব করতে গেলে তাদের রক্ত বের হচ্ছে, এটা
দুঃখজনক।
থানা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বটিয়াঘাটার
টেংরামারী এলাকা থেকে ২০/২২ বছরের অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার হয়। সে সময়
থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়। ওই ঘটনার প্রায় চারমাস পর এসআই জয়ন্ত
কুমার হোড় মেডিক্যাল রিপোর্টের পর ৯ জানুয়ারি বটিয়াঘাটা থানায় মামলা দায়ের
করেন। এই মামলায় গত ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৩টায় পানখালী ফেরিঘাট এলাকা থেকে
উত্তম মন্ডল ও আনন্দ সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের আদালতে হাজির করে
তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়। একদিন জিজ্ঞাসাবাদ পর তাদের আদালতের মাধ্যমে
জেলহাজতে পাঠানো হয়। অবশ্য পুলিশ পানখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের কথা বললেও
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের স্বজন, প্রতিবেশীরা বলেছেন পুলিশ ১২ জানুয়ারি
গভীর রাতে দুজনকে বাড়ি থেকে তুলে আনে। পরে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের
দু’দিন পর তাদের গ্রেপ্তার দেখায়।
এদিকে পিএসআই শেখ আহম্মদ কবির অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, উত্তম মন্ডল ও আনন্দকে
বাড়ি থেকে নয়, পানখালি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের নির্যাতন করার
অভিযোগও সঠিক নয়। হত্যার শিকার ব্যক্তির চারমাসে পরিচয় সনাক্ত না হওয়া
সত্ত্বেও কিভাবে সন্দেহভাজন হত্যাকারী সনাক্ত হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি
বলেন, ‘ওই নারীর লাশ উদ্ধারের সময় ইউডি মামলা ছিল। পরে এটি হত্যা মামলা
হয়েছে। তাদের সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ প্রসঙ্গে স্থানীয়
ইউপি সদস্য আবু বক্কর শেখ বলেন, আমি ৮৩ সাল থেকে টানা এ পর্যন্ত ইউপি
সদস্য। প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে অপ্রচার চালাচ্ছে। আমি বিএনপি করতাম ঠিকই
কিন্তু আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ হালদার বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত
দু:খজনক। পুলিশ যে দুজনকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করেছে; তারা
আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী, তারা কখনোই এমন কাজে জড়িত থাকতে পারে বলে
এলাকার লোকজন মনে করেন না। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
একই সাথে অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।