আঠারো কি উনিশ বছর বয়সে যখন বউ সেজে স্বামীর ঘরে এসেছেন তখন থেকেই বকুল রানী দাশের কাছে স্বামী ভগবান । এখনও স্বামী সুনীলচন্দ্র দাশের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রণামের ভঙ্গিতে দুই হাত কপালের সামনে রাখেন তিনি ; যদিও স্বামীর সঙ্গে তার সবশেষ স্মৃতিটাও প্রায় ৪৮ বছরের এক অতীত-
২৫ মার্চ, ১৯৭১ । রাত প্রায় সাড়ে ০৮.৩০ মিনিট । জগন্নাথ হলের স্টাফ
কোয়ার্টারের একচালা টিনের ঘরে স্বামীর সঙ্গে রাতের খাবার খান বকুল । কোলে
তখন দেড় মাসের ছেলে শ্যামলচন্দ্র ও আড়াই বছরের মেয়ে কুমকুম রানী । তার
ভাষায়,
– তখনো ভাবিনি, স্বামীর সঙ্গে কাটানো সেই সময়টাই শেষ স্মৃতি হবে । সাক্ষী হয়ে থাকতে হবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রাতের ।
বকুল রানী তখন সাতাশ বছরের । স্বামী সুনীলচন্দ্র জগন্নাথ হলের দারোয়ানের
কাজ করেন । স্টাফ কোয়ার্টারের পাশেই ছিল ছাত্রদের থাকার ভবন । যে কোন
মুহূর্তে কিছু ঘটে যেতে পারে, সে আশঙ্কায় স্ত্রী-সন্তানকে ঘরে রেখে বাইরে
থেকে তালা লাগিয়ে যান সুনীলচন্দ্র । ৪৮ বছর আগের সেই রাতের কথা বললেন বকুল,
– রাতে যখন একটু ঘুম ঘুম ভাব, তখনই গাড়ির শব্দ শুনতে পাই । একটু পর কানে
আসে ভাঙচুরের শব্দ । আরও একটু পর কানে আসে গোলাগুলির শব্দ ।
বকুল রানীর বয়স এখন প্রায় ৭০ বছর । কথাও বলেন অস্পষ্টভাবে ও কিছুটা ধীরগতিতে । বললেন,
– শ্যামলের বাবা এসে তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানদের কোলে নিয়ে দৌড়ে
অ্যাসেম্বলি ভবনে (অক্টোবর ভবন) যাই । দেখা হয় পাশের বাসার আরও কয়েকজনের
সঙ্গে । পাকিস্তানী সেনাদের এদিকে আসতে দেখে অ্যাসেম্বলি ভবনের ভেতরের
পূজার মণ্ডপের আড়ালে লুকায় সবাই । কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভয়ে এক বাচ্চা কেঁদে
উঠলে সবাই ধরা পড়ে ।
সে রাতে লুকিয়ে থাকা দশজনের মধ্যে সুনীল ও আরও
দুইজন দারোয়ান বাদে বাকি সবাই নারী ও শিশু । টেনেহিঁচড়ে হলের খেলার মাঠের
পশ্চিম পাশের কড়ই গাছের নিচে নেওয়া হয় সুনীল ও বাকি দুই দারোয়ানকে । ঘটনার
বর্ণনা দিলেন এভাবে দিলেন বকুল রানী,
– গাছের নিচে প্রথমে তিনজনকে
হাত-চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখে । তারপর গুলি করে সেনারা চলে গেল । তাকিয়ে
শুধু স্বামীর মাটিতে পড়ে থাকা দেহ দেখেছি । হু হু করে কেঁদেছি । কাছে গিয়ে
মানুষটাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি ।
২৬ মার্চ, ১৯৭১ । রাতভর চলা
হত্যাযজ্ঞে নিহত মানুষের লাশ পড়ে আছে যত্রতত্র । শেষ পর্যন্ত মাঠের পাশে
গণসমাধী হয় সবার । প্রাণ বাঁচাতে দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে বকুল রানী চলে যান
বিক্রমপুরে গ্রামের বাড়ি ।
যুদ্ধের পর একাই টেনেছেন সংসারের হাল । তবে
পরিশ্রমের ছাপ পড়া চেহারায় তাকালেই বোঝা যায়, কালরাত না এলে দিনগুলো অন্য
রকমও হতে পারত ।