***গীতশ্রী সাহা***
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। তখন রাত দশটা কুড়ি। নিশ্চিন্দিপুর স্টেশনে ডাউন নামখানা লোকাল এসে দাঁড়াল। ওভারহেডের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় ট্রেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেটে পৌছায়। স্টেশনে যাত্রী নামল মাত্র তিনজন। দুইজন স্টেশনের পশ্চিম দিকে চলে গেল। অন্যজন বৃষ্টিলেখা। সে স্টেশন থেকে বেড়িয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে। যাবে বন্ধু বৈশাখীর বাড়িতে। জন্মদিনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বৈশাখী। স্টেশন থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। তার অন্য এক বন্ধু আবীর নিশ্চিন্দিপুরের আগের স্টেশনে থাকে। সে এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে হয়ত। এদিকে বৃষ্টিলেখার মোবাইলের টাওয়ারও না থাকায় কাউকে কল করতেও পারছে না। গ্রাম্য এলাকা। রাস্তায় একটা মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুরের পর্যন্ত দেখা নেই। অগত্যা সে মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে হাঁটতে থাকে বৈশাখীর বাড়ির দিকে।
আকাশে হালকা মেঘ থাকলেও গোলাকার চাঁদ উঠেছে। রাস্তার দুইধারের গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো রাস্তায় এসে পড়েছে। পশলা খানেক বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় বাতাসে একটা ঠাণ্ডার আমেজ। এখনও গাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে হাওয়া এসে শরীর ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিলেখার বেশ শীত-শীত করতে থাকে। গায়ের ওড়নাটা ভাল করে জড়িয়ে নেয় সে। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই রাস্তার পাশের একটা গুমটি থেকে হঠাৎ দুটো মাতাল গোছের লোক তার থেকে খানিকটা দূরে রাস্তা আগলে দাঁড়ায়। অন্ধকারে তাদের মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিলেখার বুক ধরাস করে ওঠে। লোক দুটোর উদ্দেশ্য যে খুব একটা ভাল নয় সেটা বুঝতে আসুবিধা হয় না তার। এক মুহূর্ত অপেক্ষা। তারপরেই ব্যাগে রাখা সেল্ফ ডিফেন্স পেপার স্প্রেটা বার করে হাতে শক্ত করে ধরে। পিছন ফিরে দৌড়াতে যাবে, এমন সময় রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে আরও একটা ছায়া মূর্তি বেড়িয়ে এসে লোক দুটোর সামনে দাঁড়ায়। এই ঘটনার জন্য তারা একেবারেই তৈরি ছিল না। সেই ব্যক্তিকে দেখে মাত্রই লোক দুটো ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
ঘটনাটা এত আকস্মিক যে বৃষ্টিলেখা হতভম্ব হয়ে যায়। এদিকে সেই ব্যক্তি বৃষ্টিলেখার কাছে এসে বলে….আমি আছি তো। ভয় কি?
গলার স্বরেই বৃষ্টিলেখা চিনতে পারে। বলে…….আবীর তুই!!! এখনে? তোকে দেখে ওরা এভাবে পালাল কেন?
আবীর হেসে বলে……..তোকে নিয়ে যেতেই আসছিলাম। মাঝখানে লোক দুটো এসে পড়ল। ওরা ভয় পেয়ে পালাল কারণ হয়ত ভেবেছে আমি কোন পুলিশের লোক হব। তাড়াতাড়ি চল। তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
দুজনে হাঁটছে পাশাপাশি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বাড়ির সামনে আসতেই আবীর বলল……তুই ভেতরে যা আমি একটু পড়ে যাচ্ছি। এই বলে আবীর পাশের গলির দিকে এগিয়ে গেল।
দরজার কলিং বেল বাজাতেই বৈশাখী নিজেই দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢুকতেই বৃষ্টিলেখা দেখে সেখানে কেমন একটা থমথমে ভাব। বৈশাখী বলে……খুব কষ্ট হল তোর আজ এখানে আসতে তাই না? তোকে কল করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই ফোনে পাচ্ছিলাম না।
বৃষ্টিলেখা…..এসে পৌঁছেছি এটাই অনেক।
তারপর ট্রেনের গণ্ডগোল থেকে শুরু করে দুর্ঘটনার মধ্যে কিভাবে পড়েছিল আর কিভাবে আবীর তাকে বাঁচিয়েছে সেই কথাও বলল। তার কথা শুনে ওখানে উপস্থিত সবাই যেন হতবাক হয়ে যায়।
বৈশাখী বলে….কি বলছিস? আবীর!! হতেই পারে না। তুই অন্য কাউকে দেখেছিস।
বৃষ্টিলেখা……আমি আবীরকে চিনব না? ওর জন্যই তো আমি রক্ষা পেলাম আজ। আমাকে তোদের বাড়িতে পৌঁছেও দিল। একটু পরেই আবীর আসবে এখানে।
বৈশাখী কান্নাভেজা গলায় বলে….ও আর কোনদিন এখানে আসবেনা রে। আবীর আজ বিকালে এখানে আসার সময় লাইন পার হতে যাওয়া এক বৃদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছে। বডি পোস্ট মার্টেমের জন্য নিয়ে গেছে। মুখটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছিল জানিস। আমরা সবাই কাল ওর বাড়িতে যাব। জীবন থাকতেও কাউকে বাঁচিয়ে গেছে, জীবন হারিয়েও কাউকে বাঁচিয়ে গেল।
কথাগুলো শুনে বৃষ্টিলেখার সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যেতে থাকে। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ কিছু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা এতটাই প্রত্যক্ষ।
পরের দিন রাতের দিকে আবীরের প্লাস্টিকে মোড়া দেহটা আনা হল। মুখ দেখার উপায় নেই। শেষ শয্যায় তাকে যখন শুইয়ে দেওয়া হল সেখানে তার শেষ যাত্রা দেখতে শুধু তার বাড়ির লোক নয় তার বন্ধু প্রতিবেশী সবাই উপস্থিত। মুখাগ্নি করা হলে তার জ্বলন্ত চিতা থেকে ধূসর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওপরে আকাশের দিকে উঠে ক্রমশঃ তা মিলিয়ে যেতে থাকে। সেই দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিলেখার মনে হল এই ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে আবীর যেন মিলিয়ে যেতে যেতে বলছে…..আমি আছি তো…….।