পরিপাক হলেই বাঁচি
রবীন্দ্রনাথ তখন বয়সে তরুণ। সবেমাত্র কবি হিসেবে তাঁর নাম একটু একটু করে ছড়াচ্ছে। সেই সময় তিনি নতুন কবিতা লিখেই প্রথম শোনাতেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ কাদম্বরী দেবীকে। কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী। তিনি ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। ‘ভোরের পাখি’ কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা তিনি খুব পছন্দ করতেন। নতুন বৌঠানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল মধুর সম্পর্ক। ঠাকুরপো রবির লেখা কবিতা শুনে তিনি বলতেন, রবি তুমি বিহারীলালের মতো লেখো না কেন? বিহারীলালকে রবি নিজের গুরু মনে করতেন। নতুন বৌঠানের মুখে এই কথা শুনে রবি আরো ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করতেন, যাতে নতুন বৌঠান সন্তুষ্ট হন। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী এইভাবে রবির লেখার মান উত্তরণের চেষ্টা করতেন।
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী নিয়মিত আসতেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। কাদম্বরী দেবী তাঁকে নিমন্ত্রণ করে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতেন। বিহারীলালকে কাদম্বরী দেবী একবার নিজের হাতে একটি সুন্দর আসন বুনে দিয়েছিলেন। সেই আসন উপহার পেয়ে খুশি হয়ে বিহারীলাল কিছুদিন পরে ‘সাধের আসন’ নামে একটি কাব্য রচনা করেন।
বিহারীলালের সঙ্গে ভোজসভায় নিয়মিত ডাক পড়ত রবীন্দ্রনাথের। কাদম্বরী দেবী দুজনকেই যত্ন করে রেঁধে খাওয়াতেন।
একদিন রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের সঙ্গে খেতে বসেছেন। বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু পদ তৃপ্তি করে খাচ্ছেন দুই কবি। কাদম্বরী দেবী পরিবেশন করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রবি রান্না কেমন হয়েছে?’
রবীন্দ্রনাথ খেতে খেতেই উত্তর দিলেন, ‘বৌঠান, পাক তো ভালোই হয়েছে। এখন পরিপাক হলেই বাঁচি!’
রবীন্দ্রনাথের মুখে এই কথা শুনে বিহারীলাল ও কাদম্বরী দেবী দুজনেই হেসে ফেললেন।
দাড়িশ্বর
রবীন্দ্রনাথ একদিন এক সংগীতের আসরে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। তখন আসরে সংগীত পরিবেশন করছেন বিখ্যাত ধ্রুপদী গানের শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি তাঁর গান শুনে মুগ্ধ। গোপেশ্বরের গাওয়া শেষ হলে উদ্যোক্তারা রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে অনুরোধ করলেন, ‘গুরুদেব, এবার আপনাকে গান গাইতে হবে।’
সেদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ শ্রোতা হিসেবেই উপস্থিত ছিলেন। উদ্যোক্তাদের অনুরোধে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, গোপেশ্বরের পর এবার দাড়িশ্বরের পালা।’
রবীন্দ্রনাথের মুখে এই কথা শুনে আসরে হাসির রোল উঠল।
কুঁজোর জল
সাহিত্যিক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল একবার ভাগলপুর থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ তখন আছেন উত্তরায়ণে। বনফুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১১টার সময় দেখা করতে এলেন। বনফুল ঘরে ঢুকে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথ একটা বিরাট ঘরে বিরাট টেবিলে ঝুঁকে মন দিয়ে লিখে চলেছেন। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বনফুল অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ডেকে কবিকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। লিখতে লিখতে একসময় রবীন্দ্রনাথই মুখ তুলে দেখলেন, সামনে বনফুল দাঁড়িয়ে। বনফুলকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কখন এলে? বসো, আমার লেখাটা এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে।’
বনফুল বসলেন। রবীন্দ্রনাথ লেখা শেষ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো কী খবর?’
বনফুল করজোড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুরুদেব, অত ঝুঁকে লিখতে আপনার কষ্ট হয় না? আজকাল তো দেখি কত রকম চেয়ার বেরিয়েছে, তাতে ঠেস দিয়ে বসে আরাম করে লেখা যায়।’
বনফুলের কথা শুনে পরিহাসপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন, ‘জানি সব রকমের চেয়ারই আমার আছে। কিন্তু ঝুঁকে লিখলে লেখা বেরোয় না যে! আসলে কুঁজোর জল কমে গেছে তো তাই উপুড় করতে হয়।’
গুরুদেবের এ কথা শুনে বনফুল হেসে ফেললেন।
বিসর্জন মহড়ায়
রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে তখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি মেতে উঠেছে। নিয়মিত রিহার্সাল চলছে। একদিন একটি বড় হলঘরে ‘বিসর্জন’ নাটকের মহড়া চলছে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপস্থিত সেই মহড়ায়, আর থাকবে না-ই বা কেন, নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করছেন জয়সিংহের চরিত্রে। দীনু ঠাকুর বা দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনয় করছিলেন রঘুপতির ভূমিকায়। দীনু ঠাকুর ছিলেন লম্বা, চওড়া সুপুরুষ। নাটকের শেষ দৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ অভিনীত জয়সিংহ চরিত্রটির মৃত্যু হবে এবং দীনু ঠাকুর অভিনীত রঘুপতি চরিত্রটি শোকাহত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে মৃতদেহের ওপর। প্রথম সব কয়টি দৃশ্যের মহড়া শেষ। এবার শেষ দৃশ্যের মহড়া।
যথাসময়ে রবীন্দ্রনাথ অভিনীত জয়সিংহের মৃত্যু হলো, শোকাহতের অভিনয় করে কাঁদতে কাঁদতে রঘুপতি দীনু ঠাকুর ঝাঁড়িয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের ওপর। ঝাঁকুনি সহ্য করতে না পেরে রবীন্দ্রনাথ তখন চেঁচিয়ে দীনু ঠাকুরকে বলে উঠলেন, ‘ও দীনু, তুই ভুলে যাসনি, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি মরিনি, বেঁচেই আছি।’
এ কথা শুনে মহড়ায় হাসির রোল উঠল।
সানাই
এক ভদ্রলোক প্রথমবার শান্তিনিকেতনে এসেছেন। তিনি দেখা করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। গুরুদেবের কাছে যাওয়ার আগে ভদ্রলোককে শান্তিনিকেতনের একজন মজা করার জন্য বললেন, ‘জেনে রাখুন, গুরুদেব আজকাল কানে কম শুনছেন। আপনি কথা বলার সময় গুরুদেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জোরে কথা বলবেন। না হলে গুরুদেব কিছুই শুনতে পাবেন না!’
সেই কথা মনে গেঁথে নিয়ে ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন একটি বই পড়ছিলেন। ভদ্রলোককে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নাম কী?’
এবার ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিত্কার করে বললেন, ‘আমার নাম কানাই।’
এত জোরে চেঁচিয়ে ভদ্রলোককে কথা বলতে শুনে রবীন্দ্রনাথ অবাক হলেন। শেষে রসিকতা করে বললেন, ‘নামটা সানাই হলে আরে ভালো হতো।’
এ কথা শুনে ভদ্রলোক লজ্জা পেয়ে গেলেন।
সজীব চেয়ার
রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছড়া করে বলতেন—
‘কোনো দিন এত বুড়ো হবো নাকো আমি।
হাসি তামাশারে যবে কবো ছ্যাবলামি।’
চিররসিক রবীন্দ্রনাথ রঙ্গ রসিকতা করতে খুব ভালোবাসতেন।
একবার বেয়াইবাড়িতে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে কবিকে যথারীতি আপ্যায়ন করে একটি গদিমোড়া কেদারায় বসতে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রনাথ কেদারার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ওহে, এটা সজীব নয় তো?’
চেয়ার আবার সজীব! সবাই ভাবলেন, রবীন্দ্রনাথ এ আবার কী বলছেন! চেয়ার বা কেদারা কাঠের তৈরি, জড় পদার্থ! তা আবার সজীব হয় নাকি?
সবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এবার হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘অত ভাববার কী আছে? আমি বলছি—চেয়ারটা সজীব মানে ছারপোকা টারপোকা ভর্তি নয় তো?’
এ কথা শুনে এবার সবাই হাসতে লাগলেন।
চির ঋণী
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একজনকে গল্প করতে করতে বলছিলেন, ‘একটি লোক আমার কাছে এসে ১০ টাকা ধার নিয়ে গিয়েছিল। নেওয়ার সময় বলেছিল—গুরুদেব, আমি আপনার কাছে চির ঋণী রইলাম।’
এ কথা বলে রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘লোকটা কিন্তু সত্যবাদী ছিল, সে চির ঋণীই রয়ে গেল। ১০ টাকা সে আর আমাকে ফেরত দিয়ে গেল না।’
বলাই
সাহিত্যিক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়, যাঁর ছদ্মনাম বনফুল, এক সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শেষ হলে সবাই তাঁর বলার প্রশংসা করলেন। সভায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথও তাঁর বক্তৃতার প্রশংসা করে বললেন, ‘একটা কথা আপনারা সবাই ভুলে যাচ্ছেন কেন—বলাই তো ভালোই বক্তৃতা দেবে, ওর নামই যে বলাই। বলাই তো ওর কাজ।’
কবিগুরুর মুখে এই কথা শুনে সভায় হাসির রোল উঠল।
সূত্র : বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গ রসিকতা, অংশুমান চক্রবর্তী।