৩১শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ দুপুর ১২:০২

চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ বুধবার, মে ৮, ২০১৯,
  • 553 সংবাদটি পঠিক হয়েছে
  • আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী

চির নূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ…। আবারও ডাক এসেছে বৈশাখের। চির নূতনের দিন এসেছে। আজ বুধবার রবির আলোয় উদ্ভাসিত ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের এই কিংবদন্তি পুরুষ। নব আনন্দে জাগো আজি নবরবি কিরণে…। আজ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির আলোয় নতুন করে উদ্ভাসিত হবে বিশ্ববাঙালী। রবীন্দ্রনাথের লেখা, দর্শন, চিন্তাচেতনা, তথা বহুমাত্রিক আলোকছটার ঔজ্জ্বল্য ও মহিমায় বাঙালীর জাতিসত্তা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তার এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়। তোমারি নাম সকল তারার মাঝে…। বাঙালীর চেতনার রং স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন। চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর। এই সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার বীজ বুনে দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালীর মানস গঠনে পালন করেছিলেন অগ্রদূতের ভূমিকা। বাঙালীকে আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দেন রবীন্দ্রনাথ। দেখার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেন। যোগান সৃষ্টির প্রেরণা। বাঙালীর শিক্ষায়, নান্দনিক বোধে, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতির অভ্যাসে এবং সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলায় সারাক্ষণ আছেন তিনি। আছেন বাঙালীর নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে। তিনি তাই আমাদের লোক। তাকে আমরা পাই প্রেমে, প্রতিবাদে, আন্দোলনের অঙ্গীকারে এবং স্রষ্টার আরাধনার নিবিষ্টতায়। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আমরা তাকে পেয়েছি আত্মশক্তিরূপে। এই মহামানবের জন্মদিন উদ্যাপন মানে বাঙালীর আত্মপরিচয়ে প্রত্যয়দীপ্ত হওয়া। আজ তাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় কবিগুরুকে স্মরণ করবে বাঙালী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মধ্য দিয়ে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। তার পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদী ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভা-ারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন যেন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাদের আবেগ-অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তার স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তার আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।

মানবতাবাদী এ কবি মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তার মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ।

সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে ওঠেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলিতে কবি লিখেছিলেনÑ মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান… মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেনÑ প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তিÑ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার এ স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে। কবির ভাষায়, তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।/ সকল খেলায় করবে খেলা এই আমিÑ আহা,/ নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,/ আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।… হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নূতন তিনি। নব নব রূপে তিনি আসেন। আসবেন।

রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিভূ। তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ¯্রষ্টা। চিত্রকর, সমাজচিন্তক এবং দার্শনিক হিসেবেও বিশেষ খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতীয়তা-বোধের অন্যতম প্রধান রূপকারও বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক। বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষায় বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। বিশ্ব কবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে চিরকাল অব্যাহত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনে বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠান ॥ প্রতিবারের মতো এবারও জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আজ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও, শিলাইদহ শাহজাদপুর পতিসর দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। ‘মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ’ স্লোগানে এসব অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে বিকেল ৩টায় শুরু হবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। এতে বিশেষ বক্তৃতা করবেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন।

এর আগে বেলা ১১টায় একক বক্তৃতার আয়োজন করবে বাংলা একাডেমি। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ‘রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ : শিক্ষা ও স্বদেশ ভাবনা’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম। এছাড়াও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০১৯ প্রদান করা হবে। থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে থাকছে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। বিনোদন প্রধান টেলিভিশনগুলোতে থাকছে কবিগুরু রচিত নাটক। এক পর্বের একাধিক নাটক রাখা হচ্ছে অনুষ্ঠানমালায়। থাকছে নৃত্যনাট্য, আবৃত্তি, আলোচনাসহ নানা আয়োজন। সংবাদ নির্ভর টিভি চ্যানেলগুলোও বিশেষ পরিকল্পনা সাজিয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...
© All rights Reserved © 2020
Developed By Engineerbd.net
Engineerbd-Jowfhowo
Translate »