দুই সন্তানের মা রিজিয়া বেগম। সঠিক বয়স বলতে না পারলেও জানান ৭০ এর বেশি হবে। বয়োবৃদ্ধ এই মাকেই গত ৪ বছর ধরে কোমড়ে লোহার শিকলে তালা দিয়ে বেঁধে রেখেছে তার সন্তানরা। তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছে তাতে নেই বেড়া। অবাধে যাতায়াত করে কুকুরসহ পোকামাকড়।
এই মাকে খেতে দেওয়া হয় মাত্র এক বেলা। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে প্রায় মৃত হয়ে গেছেন তিনি। কথাও বলতে পারেন না ঠিকমতো। এভাবেই চলছে তার জীবন।
জানাগেছে, ৪ বছর আগে হঠাৎ রাতে ব্রেইন স্ট্রোক করে রিজিয়া। তার সন্তান ও স্বজনরা অর্থাভাবে তার সঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় আস্তে আস্তে মানষিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন তিনি। বয়সের ভাড়ে ন্যূব্জ এ হতভাগা মায়ের কন্ঠে তেমন কথাও উচ্চারণ হয় না এখন। যা খেতে দেওয়া হয় তাতেও ভাগ বসায় পিপঁড়ে। দুপুরে নামমাত্র তরকারি দিয়ে একবাটি ভাত দেয়া হয়। ওই তরকারি দিয়ে কোনোমতে জীবন বাচাঁতে একমুঠো ভাত দুপুরে খেলেও রাতে ও সকালের জন্য ভাত থাকলেও থাকে না কোন তরকারি। সেই ভাতে পড়ে থাকে পিপড়ের দল। কোনোমতে ওই পিঁপড়ের দখলে থাকা ভাত রাতে ও সকালে খেয়ে জীবনধারণ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিকলটির একপ্রান্ত ঘরের খুঁটির সাথে তালা বন্ধ এবং অপরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ রিজিয়ার কোমড়ে লাগানো। নোংড়া ও অপরিচ্ছন্ন একটি কাপড় পরনে তার। ঘরটির কাছেই রয়েছে খড়ের গাদা।
এমনই হৃদয় বিদারক দৃশ্যটি দেখা গেছে ঝালকাঠির রাজাপুরের উত্তর বারবাকপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি ওই গ্রামের নুর মোহাম্মদের বাড়ির মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব পাশের ইউনুচ মৃধার পরিত্যক্ত ভিটায় অরক্ষিত অবস্থায় এমন দুঃখ দুর্দশায় জীবনমৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ২০ বছর পূর্বে রিজিয়া বেগম স্বামী আব্দুল নিজাম উদ্দিন শেখকে হারায়। বর্তমানে তার এক ছেলে আব্দুর রাজ্জাক শেখ পেশায় কামার এবং মেয়ে সালমা বেগম গৃহিনী। সালমার স্বামী উপজেলার রোলা গ্রামের দিনমজুর শুক্কুর হাওলাদার। আর্থিক অবস্থায় খারাপ হওয়ায় মেয়ে সালমাও মায়ের তেমন খোঁজখবর নিতে পারেন না। ছেলে রাজ্জাকও কামারের কাজ করে কোনমতে ৪ সন্তানের পরিবার নিয়ে অতিকষ্টে সংসার চালাচ্ছে।
রিজিয়া বেগমের ছেলে রাজ্জাক শেখ জানান, ৪ বছর আগে ঘুমের ঘরে তার মা হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করেন। তারপর তার মাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন স্থানের ডাক্তার দেখিয়ে দরিদ্র রাজ্জাক সর্বশান্ত হয়ে পড়েন। এরপর তার মাকে আর অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। এমতাস্থায় তার মা দিন দিন মা মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় হয়ে প্রায় ৪ বছর ধরে লোহার শিকলে তালা লাগিয়ে ওই ঘরটি নির্মাণ করে সেখানে রাখছেন। তার মাকে নিজঘরেও রেখেছিলেন, কিন্তু তখন ঘরের আসবাপত্র ভাঙচুর ও পায়খানা প্রসাব করে নোংড়া করতেন। এ জন্য নিরুপায় হয়ে এখন ওই ঘরেই রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি বলেন, বার বার আবেদনের পরও বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা কোনো উপকারভোগী কার্ড দেয়নি মেম্বর-চেয়ারম্যানরা। এজন্য এখন আর কারও কাছে যান না রাজ্জাক। কয়েক বার ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন একবার খালে পড়ে একরাত নিখোঁজও ছিল এবং আরেকবার হারিয়ে উপজেলার রোলা গ্রামের চলে গিয়েছিল। তাই এখন আর ছাড়েন না।
তিনি তার মায়ের চিকিৎসার জন্য সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন। রাজ্জাক শেখ দাবি করেন, তার পিতার নিজাম উদ্দিন শেখের আদি পৈত্রিক নিবাস ছিল গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার টিএডি গ্রামের কুশলা বাজারের পূর্বপাশে। তার পূর্ব পুরুষরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় বলেও দাবি করেন রাজ্জাক।
রাজিয়ার ভাই জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, তিনি দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। অভাব অনটনের কারণে তার বোনের ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে ও রাতে মায়ার টানে তার বোনের ঘরে এক নজর দেখতে আসেন এবং সুবিধা অসুবিধার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে যান। তার দাবি, রিজিয়াকে যদি উন্নত চিকিৎসা করানো যেত তবে তিনি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে পেত। উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
রিজিয়া বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বার বার অনুরোধ করে জানান, একটু শিকলের বাঁধন খুলে দেও, আমি কোথাও যাব না। এভাবে বেঁধে রেখ না, আমার ভালো লাগে না। আমি অসহ্য যন্ত্রনায় আছি, মোটেও ভালো লাগে না। ভালো করে খেতেও দেয় না, তরকারি দেয় না। আমায় একটু মিষ্টি খেতে দেও। এসব বলে নির্বাক অপলক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহাগ হাওলাদার জানান, সময় করে ওই বৃদ্ধ রিজিয়ার ওখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
তিনি বলেন, সকলেরই উচিত তার মা-বাবার প্রতি যত্নবান হওয়া। নিজের সন্তানের প্রতি যেমন আদর ভালোবাস থাকে, বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতিও তেমনই আদর ভালোবাসা থাকা উচিত সকলের।