আজ থেকে একশো বছর আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার প্রতিবাদে নাইড উপাধি
ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ কিন্তু বড় অদ্ভূতভাবে সেই প্রতিবাদেও
সময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন বিশ্বকবি ৷ পাশে পাননি মহাত্মা গান্ধীকেও ৷
শুধু গান্ধীজি কেন বাংলাতেও এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন
দাসের মতো নেতারাও তাঁর পাশে ঠিকমতো দাঁড়াতে সাহস দেখাননি৷ যা দেখে
স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হয়েছিলেন কবি৷
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (অমৃতসর
হত্যাকাণ্ড) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। ১৯১৯
সালের ১৩ এপ্রিল বৈশাখি উৎসবের দিন অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর
শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
সেই ১৩ এপ্রিল দিনটা ছিল পাঞ্জাবের বৈশাখি
উৎসব৷ ফলে উৎসবের জন্য সকাল ৯টার সময় জালিয়ান ওয়ালাবাগে জমায়েত
হয়েছিল অমৃতসর ও তার আশে পাশের অঞ্চল থেকে বহু মানুষ , যাদের অনেকেরই জানা
ছিল না সরকারি নির্দেশের মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ করার কথা৷ কিন্তু ওইদিন
ডায়ার প্রায় ১০০জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে ঘিরে ফেলেন
৬-৭ একরের গোটা উদ্যানটিই৷ তারপর ডায়ারের নির্দেশে অতর্কিতে শুরু হয় গুলি
বর্ষণ৷ শোনা যায় সেদিন খরচ হয়েছিল ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি। বাঁচতে বাগের
মাঝখানে থাকা কুয়োতে ঝাঁপ দিলে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা
হয়। ব্রিটিশ সরকারি হিসেব বলে সেদিন ৩৭৯জনের মৃত্যু এবং ১১০০জন আহত
হয়েছিল৷ যদিও বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল হাজারের অনেক বেশি৷
ওই ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের
ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপ বেরিয়ে পড়ে৷ এ খবর জানার পর
রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত৷ তিনি মনে করেন ইংরেজের এমন
বর্বোরচিত আচরণের কথা বিশ্ববাসীর জানা উচিত৷ কিন্তু এমন নৃশংস ঘটনার পরেও
গান্ধীজি কিংবা কংগ্রেসের নেতাদের দিক থেকে তেমন কোনও প্রতিবাদ গর্জে উঠতে
দেখা গেল না৷
তখন রবীন্দ্রনাথ একটা প্রস্তাব দিয়ে
অ্যান্ড্রুজকে পাঠালেন গান্ধীজির কাছে ৷ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল- তিনি
গান্ধীজিকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবে যাবেন কারণ তখন সেখানে পাঞ্জাবের বাইরের
লোকেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার৷ তাঁরা দুজনে ঢুকতে গেলে
নিশ্চিত গ্রেফতার হবেন৷ আর গান্ধী গ্রেফতারের খবর চাপা থাকবে না ফলে গোটা
বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়বে৷ কয়েকদিন বাদে অ্যান্ড্রুজ ফিরলেন ঠিকই তবে
জানালেন- কবির প্রস্তাবে গান্ধীজি রাজি নন৷ ওই সময় সরকারের সঙ্গে কোন রকম
প্রত্যক্ষ সংঘাতে যেতে রাজি নন মহাত্মাজি৷
কোনও বিরূপ মন্তব্য করলেন না ঠিকই তবে কবি
চরম আঘাত পেলেন ৷ তখন তাঁর মনের ভিতর চরম অস্থিরতা৷ ঠিক করলেন চিত্তরঞ্জন
দাশের সঙ্গে দেখা করবেন৷ কবি নিজেই গেলেন তাঁর কাছে ৷ কবির প্রশ্ন
দেশবন্ধুর কাছে – পাঞ্জাবের ঘটনায় বাঙালিরা কেন প্রতিবাদ করছে না? কেন
এখানকার কংগ্রেস নেতারা নীরব? রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রতিবাদ সভা ডাকতে বলেন
এবং সে সভায় কবি স্বয়ং সভাপতি হতে রাজি বলেও জানালেন৷ সেদিন রবি ঠাকুর
চেয়েছিলেন ওই সভাটি যেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় ৷ কিন্তু
বাংলায় আরও অনেক কংগ্রেস নেতা রয়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে তাঁর একার পক্ষে এ
ব্যাপারে কথা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান চিত্তরঞ্জন৷ তিনি কবিকে পাল্টা
প্রস্তাব দেন বরং ওই সভাটি নয় রবীন্দ্রনাথ নিজেই ডাকুন৷ সেদিন বিস্মিত
রবীন্দ্রনাথ – বুঝে উঠতে পারলেন না এ বঙ্গের কংগ্রেস নেতাদের ব্রিটিশদের এত
ভয়ের কারণটা কী ? চিত্তরঞ্জনের মনোভাব বুঝে আর সেখানে বসে সময় নষ্ট না
করে ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে৷
সেদিন কবির জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন
প্রশান্ত মহলানবিশ৷ লেখালেখির ব্যাপারে কিছু কাজ ছিল৷ সেদিন আর কোনও কাজ
হবে না তাই কবি তাঁকে চলে যেতে বলেন৷ রবি ঠাকুরের থমথমে মুখ দেখে একরাশ
দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর একান্ত অনুগত প্রশান্ত ৷ তাই
রাতে বাড়ি ফিরলেও পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই আবার জোড়াসাঁকো যান তিনি৷
কবির ঘরে গিয়ে দেখলেন তিনি সারারাত না শুয়ে কিছু লেখালিখিতে ব্যস্ত ৷ তখন
ইংরেজিতে লেখা সেই কাগজগুলি প্রশান্তকে পড়তে বলেন কবি৷
লেখাটা হাতে নিয়ে প্রশান্ত দেখলেন অনেক
কাটাকুটিতে ভরা বড়লাট চেমসফোর্ডকে লেখা চিঠি যাতে বলা হয়েছে- কবি নাইট
উপাধি ত্যাগ করছেন৷ পাশাপশি ডেকে পাঠালেন অ্যান্ড্রুজকে চিঠিটা পড়ে দেখতে ৷
ঠিক ঠিক আছে তবে ভাষাটা একটু মোলায়ম করার কথা বলেছিলেন অ্যান্ড্রুজ ৷
কিন্তু কবি তাতে রাজি নন৷ প্রতিবাদই যখন তখন ভাষা নরমের কি দরকার?
কবির মতে, ইংরেজ সরকার একদিন বেশ খাতির
করে তাঁকে নাইটহুড দিয়েছিল ঠিকই কিন্ত যে সরকার দেশের লোকের উপর এমন
অত্যাচার করতে পারে সে সরকারের দেওয়া খেতাব রাখার কোনও দরকার নেই৷ তাই
জালিয়ানওলায়াবাদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইড উপাধি ফেরত দিচ্ছেন৷
রাজনৈতিক নেতাদের পাশে না পাওয়ায় আর কোনও সভা করার তাগিদ অনুভব করেননি৷
তিনি তখন চেয়েছিলেন একেবারে নিজের মতো করেই লিখে প্রতিবাদ জানাতে৷ আর
সেটাই করলেন৷
নাইটহুড ফেরত দিতে চেয়ে বড়লাট
চেমসফোর্ডকে লেখা সেই চিঠিটিকে তার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল
অ্যান্ড্রুজকে৷ আর প্রশান্ত সেই চিঠির কয়েকটি কপি করে পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন
সংবাদপত্র ও পত্রিকার দফতরে৷ রাজনীতিবিদদের নীরবতার মধ্যে কবির একক
প্রতিবাদ সেদিন অবশ্যই অন্যমাত্রা পেয়েছিল ৷ এর কিছুদিন পরে অবশ্য
গান্ধীজি তাঁর অবস্থান বদলেছিলেন এবং পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন৷ পাশাপাশি
রাজনীতির মোড় ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাই এই ইস্যুতে তাঁদের
অবস্থান বদলেছিলেন ৷ তবে জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার