লেখকঃ ভানুলাল দাস
—————————————–
রাজা রামমোহন রায় ও রবীন্দ্র পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর যদিও ব্রাহ্মণ ছিলেন, তথাপি তাঁরা বেদভিত্তিক বর্ণভেদহীন হিন্দুধমের্র সংস্কারস্বরূপ ‘ব্রাহ্মধর্ম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এতে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দির কোলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতির অভূতপূর্ব জাগরণকে ‘ব্রাহ্ম-জাগরণ’ বললে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না।
ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় বলা হয়েছিল এ ধর্মে অমানবিক বর্ণপ্রথা থাকবে না। নিরাকার ঈশ্বরের পূজা হবে। হিন্দুদের কুসংস্কার বর্জন করা হবে।সতীদাহসহ নারীর উপর সকল নিপীড়ন বন্ধ করা হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো হবে। ফলে দলে দলে শিক্ষিত হিন্দু ছেলেরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। আনন্দমোহন বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী এ রকম স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। বর্ণভেদহীন এই ধর্মের দ্রুত বিস্তার হতে থাকে।
বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা ব্রাহ্মদের ম্লেচ্ছ, যবন হিসাবে আখ্যায়িত করলেন। যদিও ব্রাহ্মধর্ম বেদ অনুসারি এবং তারা বেদ কথিত নিরাকার ঈশ্বরের উপাসক, তথাপি বর্ণহিন্দুরা ব্রাহ্মদের অহিন্দু হিসেবে আখ্যায়িত করল।
রবি ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণভেদহীন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে আসার পর আবারও তিনি জোরেসোরে বর্ণভেদ প্রথা চালু করার চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করলেন ব্রাহ্মধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি শাখা, তাই ব্রাহ্মধর্মে বর্ণপ্রথা বলবৎ থাকবে। ফলে ব্রাহ্মধর্ম নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলল। এই অবস্থায় ব্রাহ্মসমাজ শুদ্র কেশব সেন ও ব্রাহ্মণ দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে দু‘ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এবং অনিবার্য অবলুপ্তির দুর্ভাগ্য বরণ করে।
এতে করে ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এদ্দিন সনাতন হিন্দুদের অবস্থা ছিল সাপের ছুঁচো গেলার মত– ব্রাহ্মধর্মানুসারিদের কৃতিত্ব গিলতেও পারছিলেন না, উগলাতেও পারছিলেন না। কারণ ব্রাহ্মদের তারা আগেই হিন্দুধর্মের বাইরে নিক্ষেপ করে ম্লেচ্ছ জ্ঞান করতেন। এবার যেই ব্রাহ্মধর্ম বিলুপ্ত হবার দশা, তখনি তারা বগল বাজানো শুরু করে ধেই ধেই নৃত্য শুরু করে দিলেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বর্ণহিন্দুর জন্য বড়ই প্রশান্তি নিয়ে এল। তারা ব্রাহ্ম রবি ঠাকুরের কৃতিত্বকে বর্ণহিন্দুর মহিমা হিসেবে ধরে নিলেন। এইরূপ বিরামহীন প্রচারও দিলেন। এখনো তাই চলছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ছিলেন, মূর্তিপূজারি হিন্দু ছিলেন না, এ সত্য হিন্দুরা কস্মিনকালেও মুখে আনে না।