অর্থনীতির দিক দিয়ে তারা দরিদ্রস্য দরিদ্র | জাতপাতের সমাজে তারা নীচু থেকে নীচুতর স্তরে | তারা ভূমিহীন কৃষক মুশহর | বিহারের গয়ার অত্রি ব্লকে ৬০ টি গ্রামে বাস এই অন্ত্যজদের | পানীয় জল‚ বিদ্যুৎ‚ শিক্ষা‚ স্বাস্থ্যর মতো ন্যূনতম পরিষেবাগুলো তাদের কাছে বিলাসিতা | তাদেরই একজন ছিলেন দশরথ মাঝি |
থাকতেন গেহলৌর পাহাড়ের কাছে কারজানি গ্রামে | নিকটতম শহর ছিল ওয়াজিরগঞ্জ | সেখানে যেতে গ্রামবাসীদের সবাইকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ট্রেক করতে হত ৭০ কিলোমিটার | ওই পথ ধরে পানীয় জল আনতে গিয়েছিলেন দশরথের স্ত্রী ফাগুনি দেবী | গ্রামের অন্য বধূদের সঙ্গে | ফেরার সময় পড়ে যান পাহাড়ে | আর ভাল হননি | উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যান |
সেদিন পণ করেন দশরথ | ক্ষমতাসীন প্রশাসন যখন তাঁদের জন্য কিছু করবে না‚ দশরথ স্থির করেন যা করার তিনি নিজেই করবেন | স্ত্রীকে হারানোর শোক তাঁকে অবিচল রাখে লক্ষ্যের দিকে | গবাদি পশু বেচে দশরথ কেনেন হাতুড়ি‚ ছেনি আর বাটালি | ছেড়ে দেন মনিবের জমিতে চাষের কাজ |
সামান্য এই তিন জিনিস দিয়ে শুরু হয় দশরথের লড়াই | গেহলৌর পাহাড়ের মাথায় উঠে কাটতে লাগলেন পাথর | সম্বল হাতুড়ি-ছেনি-বাটালি‚ নিজের দুটো হাত আর স্ত্রীর স্মৃতির প্রতি অদম্য ভালবাসা |
১৯৬০ থেকে ১৯৮২‚ টানা ২২ বছর ধরে পাহাড় কাটেন দশরথ | অবশেষে পাহাড়ের বুক চিরে দেখা দিল পথ | তৈরি হল ৩৬০ ফিট দীর্ঘ‚ ৩০ ফিট উঁচু আর ২৫ ফিট চওড়া পাকা রাস্তা | গেহলৌর পাহাড়ের পিছনের গ্রামগুলো থেকে ওয়াজিরগঞ্জের দূরত্ব যোজন থেকে কমে দাঁড়াল তিলেক | ৭০ কিলোমিটার ট্রেকের বদলে মাত্র ৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পেরোলেই হাতের মুঠোয় চলে এল সভ্যতার আলো | গেহলৌর-সহ ৬০ টি গ্রামের মানুষের কাছে দশরথ হয়ে গেলেন ‘বাবা’ |
নিজের কাজের জন্য সরকারি কোনও স্বীকৃতি‚ সম্মান বা পুরস্কারের অপেক্ষা করেননি সত্তরোর্ধ্ব দশরথ | পরোয়া করেননি কোনও শাস্তির আশঙ্কারও | তাঁর মাথায় শুধু ছিল‚ পঙ্গু যদি গিরি লঙ্ঘন করতে পারে‚ তাহলে তিনিও পারবেন পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তাকে সূর্যের আলোর মুখ দেখাতে |
দশরথ বলেছিলেন‚ তিনি না করলে অন্য কেউ হয়তো রাস্তাটা করত | নিজের অসমসাহসী অসম্ভব কৃতিত্বকে এভাবেই বর্ণনা করে গিয়েছিলেন এই বৃদ্ধ | কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০৭ সালে চিরতরে থেমে যায় মাউন্টেন ম্যান-এর হাতুড়ির শব্দ |
দশরথ চলে গেছেন | রয়ে গেছে তাঁর স্বপ্নের রাস্তা | নাম দেওয়া হয়েছে ‘দশরথ মাঝি রোড ‘ | আর রয়ে গেছে দশরথের পরিবারের দারিদ্র্য আর অনটন | তাঁর ছেলে এবং পুত্রবধূ দুজনেই প্রতিবন্ধী | নিজের পরিবারের জন্য শুধু ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেননি দশরথ | রাস্তা নির্মাণের কুর্নিশ স্বরূপ পেয়েছিলেন ৫ একর জমি | নিজের গ্রামে সেই জমিটুকুও তিনি দিয়ে গিয়েছেন হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে |