লেখকঃ ভানুলাল দাস
—————————————————————–
যদিও বর্ণাশ্রম প্রথা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বা এই রকেট সাইন্সের যুগে ক্রমশ শক্তি হারিয়ে ফেলছে, তথাপি এমন বলা যায় না যে এই কুপ্রথা একেবারে শক্তিহীন হয়ে গেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে মানব সমাজ ধর্ম সংস্কৃতি জাতপাতের উর্ধে উঠে বিশ্ব মানবতার জয়গান করছে। মানবতাকে ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে নিতে না পারলে ধর্মীয় সকল আচার-অনুষ্ঠানই হয়ে যায় অর্থহীন ও তাৎপর্যহীন।
বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা সমাজাভ্যন্তরে গোপন ক্যান্সার হয়ে বাসা বেঁধে আছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হবে, ধর্মবেত্তারা বক্তৃতা বিবৃতিতে এবং শিক্ষিত ও জ্ঞানীরা কথাবার্তায় জাতিভেদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত; কিন্তু আসলে, ভেতরে ভেতরে সবাই এই কুপ্রথা মনে প্রাণে লালন পালন করে থাকেন।
এমনিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র ও অতি-শুদ্র, এ সকল বিভক্তিতে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ শতধা বিভক্ত। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত সংখ্যাগরিষ্ট শুদ্রের মধ্যেও শতশত ভাগ-বিভক্তি– কায়স্থ, বৈদ্য, জল-ছোঁয়া-জাত, জল-নাছোঁয়া-জাত অতি-শুদ্র, কত রকমের যে বিভক্তি!
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হিন্দুর সংখ্যা এমনিতে কমে গেছে, এর মধ্যে এসব কুসংস্কারচ্ছন্ন জাতপাতের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দুর অস্তিত্বের মূল্যেৎপাঠন করতে উদ্যত আজ। মৃতের সৎকার, বিবাহ, সামাজিক মেলামেশা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অন্তলীন হিংসা ও ঘৃনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি এতই প্রবল যে, হিন্দু সমাজের ঐক্য প্রক্রিয়াকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। ঐক্যহীন সমত্বহীন এ হিন্দু সমাজ ক্ষয়িষ্ণু এবং এটি ক্ষয়িষ্ণু হতে বাধ্য।
ভাবলে অবাক হতে হয়, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যকে, বৈশ্য শুদ্রকে, শুদ্র নিজেদের উপজাতগুলোকে এবং অতি শুদ্রকে ঘৃনা করে। এ যেন ঘৃনার অন্তহীন এক দুষ্টচক্র। বিবাহ অন্তোষ্টীক্রিয়া পূজা-পার্বণে পরস্পর বৈষম্য প্রদর্শন করে নিজেদের প্রাণশক্তিকে ধ্বংশ করে ফেলেছে হিন্দুরা। মণীষীদের “অখন্ড সনাতন হিন্দু সমাজ” এখনো অধরা কল্পনা হয়ে র’লো। আর এর ফলাফল হিন্দুরা হাতেনাতে পাচ্ছে।জাতিভেদের ভয়াবহ বিষফল খেয়ে তারা নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছে ।
#বেদে জাতিভেদ তত্তঃ-
চতুর্বর্ণ বা বর্ণাশ্রম প্রথা বেদ সমর্থিত বলে যারা দাবি করেন তারা ঐতিহাসিক ভ্রান্তি বশত এমনটি করেন, অথবা জ্ঞানত তারা এর অপব্যাখ্যা করে বর্ণাশ্রম প্রথাকে ধর্মীয় ভিত্তি দিয়ে মেকি দার্শনিকতার মোড়কে সজ্জিত করেন। মানবতা বিরোধী ও অযৌক্তিক এ জঘন্য প্রথা ধর্মের নামে সমর্থন করা এই বৈশ্বিক যুগে লজ্জাষ্কর। দুনিয়ার জ্ঞানী-গুণী মানুষ এ জঘন্য প্রথার কথা জেনে বিস্ময়াভূত ও হতবাক হয়ে যান। মানুষ হয়ে মানুষকে ছোট ভাবা, জন্মের জন্য একজন মানুষকে হীন চোখে দেখে ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানুষের ধর্ম হতে পারে না। এমন ধর্ম মানুষের নয়, অসুরের ধর্ম।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। বেদ অর্থ জ্ঞান। বেদশাস্ত্র — ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব্ব এই চার ভাগে বিভক্ত; আবার প্রতিটি বেদ মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এই চার খন্ডে সংকলিত।
উপনিষদে জগৎ-জীব-ঈশ্বর সম্পর্কে দার্শনিক মতবাদ রয়েছে। একে আশ্রয় করে বেদান্ত দর্শন বা বেদের শেষের দর্শনের সৃষ্টি। ঐতিহাসিকদের মতে, আনুমানিক খ্রি: পূ: চার থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে আর্যরা বেদ রচনা করেন। সেই সময় থেকে বিশেষ ছন্দাকারে রচিত বেদ গুরুশিষ্য পরম্পরা মুখস্থ করা হত; তাই এটিকে শ্রুতিশাস্ত্রও বলা হয়ে থাকে। শুনে শুনে যা স্মরণ রাখা হয় তাই শ্রুতি।
বেদের বাণী লিপিবদ্ধ করা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে মহপাপ হয়, শুধু গুরুমুখে শুনে শুনে মুখস্থ করে বেদ ধারন করতে হয়।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে বেদ অলৌকিক, অপৌরষেয়। ঈশ্বরবাণী। ঋষিরা বেদমন্ত্রের দ্রষ্টামাত্র, স্রষ্টা নন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু ঋষির নিকট বেদের বাণী প্রকাশিত হয়েছে এবং বেদগ্রন্থ ক্রমশ হয়েছে স্ফীত থেকে স্ফীততর। একদা অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, একক মানুষের পক্ষে অখন্ড বেদ মুখস্থ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায়, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস নামক এক ঋষি সমগ্র বেদকে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব্ব, এই চারভাগে বিভক্ত করে শিষ্যদের মুখস্থ করতে বলেন। সেই থেকে অখন্ড বেদ চারভাগে বিভক্ত।
মনু শাস্ত্র অনুসারে যদিও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিনবর্ণ বেদপাঠের অধিকারী; কিন্তু শুধু ব্রাহ্মণই বেদ শেখাতে পারবে অন্য দু‘বর্ণকে। শুদ্র ও নারীর বেদপাঠ, শ্রবণ বা উচ্চারণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেহেতু, বেদ দীর্ঘকাল অলিপিবদ্ধ ছিল, ব্রাহ্মণাদি দ্বিজবর্ণরা বংশানুক্রমে বেদ মুখস্থ করেছে এবং অন্যদের শিখিয়েছে, তাই এ অনুমান সংগত যে, দীর্ঘ ঐতিহাসিক কালপর্বে কোন শ্রেণী বা গোষ্টী নিজ স্বার্থে মনগড়া কিছু শ্লোক ঈশ্বরবাণী হিসেবে বেদে প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের প্রবেশ ঘটাতে পারে।
ঋকবেদের জাতিভেদ সম্বলিত ‘পুরুষসূক্ত’ নামক শ্লোকটি এমনি একটি প্রক্ষিপ্ত শ্লোক।
জাতিভেদের সমর্থনে সবচেয়ে মোক্ষম যুক্তিটি দেয়া হয়ে থাকে যে, এটি সর্বপ্রাচীন ঋকবেদ সমর্থিত। বেদ ঈশ্বরের বাণী, সুতরাং সকল হিন্দুর অবশ্য মান্য।
ঋকবেদের প্রথমদিকের নবম মন্ডল পর্যন্ত সহস্রাধিক শ্লোকে কোথাও জাতিভেদের কথা নেই। অনেক পরে দশম মন্ডলের নব্বই নম্বর ‘পুরুষসুক্ত’ নামক শ্লোকটি জাতিভেদের সূচনাকারি। এ শ্লোকটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় যজু, সাম, অথর্ববেদেও রয়েছে। তবে ঋকবেদের শ্লোকটিই সবচেয়ে প্রাচীন-
‘ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্ বাহু রাজন্যকঃ কৃতঃ।
ঊরু তদস্য যদ্ বৈশ্যঃ পদত্যাং শুদ্রোহজায়তে।।
— ব্রাহ্মণ সেই পুরুষের (সৃষ্টিকর্তার) মুখ হলেন, ক্ষত্রিয় বাহু হলেন, বৈশ্য তাঁর ঊরু হলেন আর পদ হতে শুদ্রের জন্ম হল।
শ্লোকটি অদ্ভূত রকম অসংগতিপূর্ণ এবং বৈপরীত্যে ভরপুর। অযৌক্তিক ও মানবতাবিরোধী সূক্তটি বুঝার জন্য হিন্দুদের মানব সৃষ্টির ধর্মীয় উপখ্যানটি জানা জরুরি।
সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর প্রথমে দেবতাদের সৃষ্টি করলেন;অতপর তিনি নিজে প্রজাপতি নামক বিরাট পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দেবতাদের বললেন, তাকে যজ্ঞে বলি দিতে। পশুবলি দেবার মত বিরাট পূরুষকে দেবতারা বলি দিলেন। তার খন্ডিত দেহ মহাবিশ্ব ও স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে পরিণত হল। কিন্তু তার মুখমন্ডল, বাহু. উরু ও পদের কী হল? প্রজাপতির মুখ ব্রাহ্মণে, বাহু ক্ষত্রিয়ে ও ঊরু বৈশ্যজাতিতে পরিণত হল, আর পদ থেকে শুদ্র জন্ম নিল।
লক্ষণীয় যে, ঈশ্বরের খন্ডিত অঙ্গ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যে রূপান্তরিত হলেও তার পদদ্বয় রূপান্তরিত হয়ে শুদ্রজাতি হয়নি; বরং পদ থেকে শুদ্র জন্ম নিয়েছে। ‘মাসীদ’ ও ‘জায়তে’ শব্দ দ্বারা বৈষম্য করা হয়েছে। যেহেতু মুখের অবস্থান বাহুর উপরে, বাহুর অবস্থান ঊরুর উপরে এবং পদদ্বয় শরীরে সর্বনিম্নে; তাই ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ট, তারপর ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং সর্বনিম্ন জাতি শুদ্র। যেহেতু শুদ্র ঈশ্বরাঙ্গ থেকে সৃষ্ট নয়-, ঘর্ম বা বিষ্ঠার মত উপজাত মাত্র,তাই শুদ্র হীনতর, ঘৃন্য, মন্ত্রহীন এবং ঈশ্বর আরাধনার অযোগ্য তারা।
হিন্দু ধর্মালম্বী ব্যতিত কোন মানুষের পক্ষে এমন অদ্ভূতরে যুক্তি বুঝার সাধ্য কি? এমন যুক্তি দেখে মহাজ্ঞানী আলবেরুনি ‘তাহরিক-ই- হিন্দ’ (ভারততত্ত্ব) গ্রন্থে চরম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মহামতি গৌতমবুদ্ধ ব্রাহ্মণ জাতির শ্রেষ্ঠতাকে পরিহাস করে বলেছিলেন, ‘সকল নারীই প্রকৃতির নির্ধারিত পথে শিশুর জন্ম দেয়, ব্রাহ্মণ নারী এর ব্যতিক্রম নয়। ঈশ্বরের মুখ থেকে নয় নারীর যোনীপথে ব্রাহ্মণসহ সকলকে জন্ম নিয়ে ধরায় অবতীর্ণ হতে হয়।’
আধুনিক ঐতিহাসিক ও বেদ বিশেষজ্ঞগণ একমত যে, বৈদিকযুগে কোন বর্ণভেদ ছিল না। ভারততত্ত্ববিদ ম্যাক্সমূলার (যার বিস্ময়কর বেদজ্ঞান দেখে বর্ণ হিন্দুরা নাম দিয়েছে মোক্ষমূলার) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এ শ্লোকটি ঋকবেদের অনান্য প্রাচীন শ্লোকের ভাষা থেকে ভিন্ন অর্থাৎ এটি পরে যুক্ত করা হয়েছে এবং এটি একটি প্রক্ষিপ্ত শ্লোক।
বেদ গবেষক ম্যাক্সমূলার বলেন,
If then with all the documents before us, we ask the question, DOES CASTE AS WE FIND IN MANU AND AT THE PRESENT DAY, FORM PART OF THE MOST ANCIENT RELIGIOUS TEACHING OF THE VEDA? We can answer a decided ‘NO’.
— আমাদের সম্মূখে যে সকল দলিল শাস্ত্রাদি প্রমাণ রয়েছে তার আলোকে যদি প্রশ্ন করি, মনুসংহিতার কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে জাতিভেদ প্রথা বলবৎ রয়েছে তা কি সর্বপ্রাচীন ধর্মশিক্ষা বেদ সমর্থিত? আমরা অবশ্যই বলব ‘না’।
ঋকবেদের নবম ভাগের ১১ নং সুক্তে ঋষি বলছেন, ‘হে সোম সকল ব্যক্তির কার্য একরকম নহে; আমাদের কার্যও নানাবিধ। দেখ তক্ষ (সুত্রধর) কাঠ চেরাই করে, বৈদ্য রোগ চিকিৎসা করে, স্তোতা যজ্ঞকর্তাকে চাহে। দেখ আমি স্তোত্রাকার, আমার পুত্র চিকিৎসক, কন্যা আমার যবভর্জনকারিনী (ভাজা পোড়া তৈরি,বর্তমান শুদ্রের কাজ)।’ ঋক- ৯/১১
মনুর শাস্ত্রানুসারে, ব্রাহ্মণ পুত্র চিকিৎসক হলে জাত যেতো, কারণ শুদ্রকে অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করতে হতো। আর ভাজাপোড়া তৈরী করে বিক্রি করা ব্রাহ্মণের জন্য গর্হিত কাজ, এটি অধম শুদ্রের কাজ হিসেবে গণ্য হত।
তাই এ শ্লোক প্রমাণ দেয় যে, বৈদিক যুুগে কোনো বর্ণবিভাজন ছিল না। বেদজ্ঞ পন্ডিত, ঐতিহাসিক, সংস্কৃত-বিশষজ্ঞ সকলেই একমত যে, বর্ণভেদ সম্বলিত পুরুষসূক্ত ঋকবেদে প্রক্ষিপ্ত এবং পরবর্তী কালে কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সংযোজন করেছে এবং ঈশ্বরের বাণী বলে চালিয়ে এসেছে। ঈশ্বরের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কারসাজির বড় প্রমাণ ঋকবেদের এই পুরুষসূক্ত।