লেখকঃ ভানুলাল দাস
———————————————————————
অবতার রামচন্দ্রের জীবন কাহিনী নিয়ে কবি বাল্মিকী মহাকাব্য রামায়ণ রচনা করেন। অযোধ্যার অধিপতি রামচন্দ্র এবং দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ, দুইজন হলেন বর্তমান যুগের হিন্দুদের প্রধান অবতার। বাঙালি চৈতন্যদেব মুক্তির উপায় হিসেবে শুদ্র ও নারীকে দুজনের নাম নিতে বলেছেন। হরে কৃষ্ণ হরে রাম।
ইসকন, ইদানিং সারাবিশ্বে রামনাম-কৃষ্ণনাম প্রচার করছে; যদিও উত্তরভারতে রাম যত জনপ্রিয় কৃষ্ণ ততটা নন। মহাত্মা গান্ধী রাম ভক্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার শ্মশান সমাধিতে ‘ হায় রাম ’ উৎকীর্ন।
এ হেন অবতার রামচন্দ্র নিরাপরাধ শুদ্র শম্বুককে হত্যা করিয়েছিলেন। কারণ, উক্ত শুদ্র বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে ঈশ্বর আরাধনা করছিলেন। কাহিনিটি হল —
রাম রাজত্বে জনৈক ব্রাহ্মণের শিশুপুত্রের অকাল মৃত্য ঘটে। এর জন্য ব্রাহ্মণসমাজ রাজার অধর্মকে দায়ী করেন এবং রাজাকে অভিশম্পাৎ দিতে পুত্রের মরদেহ নিয়ে রাজসভায় হাজির হন। রাজ্যে অধর্ম না হলে ব্রাহ্মণপুত্র অকালে মরবে কেন? এ অবস্থায় ব্রহ্মশাপ থেকে রামকে রক্ষার জন্য অমাত্য ও রাজপুরোহিত মতামত দিলেন যে, রাম হলেন সাক্ষাৎ ধর্ম, তিনি কখনও অধর্ম করতে পারেন না। নিশ্চয় রাজ্যে অন্য কেউ গুরুতর অধর্মাচরণ করেছে, যার পাপে ব্রাহ্মণপুত্র অকালে মারা গেছে। ঐ পাপীকে খুঁজে বের করতে চতুর্দিকে সৈন্যসামন্তরা ছুটে গেল।
অবশেষে গভীর অরণ্যে শুদ্র শম্বুককে বেদমন্ত্র পাঠ করে কঠোর তপস্যা করতে দেখা গেল। রাম-সেনাপতি ও ভ্রাতা লক্ষণ তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করলেন। যেহেতু, শুদ্রের বেদপাঠ নিষিদ্ধ- শুদ্র শম্বুক তা করে মহাপাপ করেছিলেন।
শম্বুক শুদ্রের ছিন্ন মস্তক রাজদরবারে নেয়া হলে, রাম এই হত্যা অনুমোদন করে বললেন, এই শুদ্রের অপরাধেই ব্রাহ্মণপুত্রের অকাল মৃত্য হয়েছে। শুদ্র শম্বুক হত্যার পর ধর্ম আবার প্রতিষ্ঠিত হল! এবং মৃত ব্রাহ্মণপুত্র পূর্নজ্জীবন ফিরে পেল। এভাবে প্রভু রামচন্দ্র ধর্ম রক্ষা করলেন।
কী অমানবিক ধর্ম স্থাপনের নমুনা!
অবতার রামচন্দ্রের নিরাপরাধ শুদ্র হত্যাকে রামভক্ত মহাত্মা গান্ধী বরাবর অস্বীকার করে গেছেন। তিনি বলেন, প্রভু রাম কখনও এমন অন্যায় করতে পারেন না।
গান্ধীজী ‘চন্ডাল গুহকের’ সংগে রামচন্দ্রের মিত্রতার গুণকীর্তন করে শুদ্রহত্যা বিষয়টি এড়াতে সচেষ্ট ছিলেন।
কিন্তু ‘ ব্রাহ্মণ গান্ধীর আক্ষেপে ‘ এ মহাসত্য অবলুপ্ত হয় না। কারণ, রামায়ণের সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা সব ভার্সানেই ঘটনাটির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, প্রকৃতই তা ঘটেছিল।
গান্ধী দলিত ও অস্পৃশ্যদের বর্ণহিন্দুর নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য তাদের উচ্চবর্ণে ঠাঁই দেয়ার কথা কখনো বলেন নি। বরং তাদের ‘ হরিজন ’ (ঈশ্বরের মানুষ) আখ্যা দিয়ে সমাজে চিরদিনের জন্য ট্রেডমার্ক দিয়ে পতিত করেছেন। হরিজনদের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আজও কোন বর্ণে জায়গা দেয়নি।
হরিজন নেতা বি. আর. আম্বেদকর এজন্য মহাত্মাজীর তীব্র সমালোচনা করেছেন এই বলে, অস্পৃশ্যদের মঙ্গল চাইলে তিনি তাদের উচ্চবর্ণে স্থান দিতে পারতেন; আর গান্ধীর মুখের কথা তখন অবতারবাক্য হিসেবে হিন্দুসমাজ সম্ভবত মেনে নিত।
গান্ধিজী বলতেন,‘জন্মে জায়তে শুদ্র।’ জন্ম মাত্র প্রতিটি মানুষ শুদ্র। মহাত্মা গান্ধী সকল হিন্দুকে একটি মাত্র বর্ণ হিসাবে পরিচয় দিতে চেয়েছেন, সেটা হল একবার জন্ম হওয়া শুদ্র (অন্য তিনবর্ণ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য, এদের জন্মসংস্কার ও উপনয়ন সংস্কার হয় বলে তাদের বলা হয় দ্বিজ অর্থাৎ যে দু‘বার জন্ম নেয়)। তার মতে, সকল হিন্দু জন্মসূত্রে শুদ্র বলে পরিচিত হবে, যেখানে ব্রাহ্মণাদিসহ অবর্ণ বা অতিশুদ্র, হরিজন সবই শুদ্র হিসেবে পরিগণিত হবে। পরবর্তীতে গুণ-বিকাশ ও কর্মানুসারে ব্যক্তি বিশেষকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি বলা যেতে পারে; তবে তা কখনও বংশানুক্রমিক হবে না। বংশগতভাবে বর্ণ-অবর্ণ সকল হিন্দুই শুদ্র হিসেবে পরিচিত হবে।
গান্ধীজী তার এই তত্ত্ব বাস্তবে প্রয়োগ করতে তেমন চেষ্টা করেন নি; বরং তিনি মনে করতেন, শুদ্র বা অস্পৃশ্যরা এ জীবনে সৎ ও মহৎ কর্ম করলে পরজন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্ম নেবেন।
মহাত্মার কথিত শুদ্রের ‘সৎ ও মহৎ’ কর্মগুলো কী কী? ব্রাহ্মণদের পদসেবা, তাদের অন্যায় অবিচার নির্যাতন বিনা প্রতিবাদে সয়ে যাওয়া ?
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণ গান্ধীজী খুব কম কথা বলে গেছেন, হয় তো থলের বিড়াল বের হয়ে যাওয়ার ভয়ে(?)
———————————————————————-