র দফতরের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে। এদের কীভাবে ফেরত পাঠানো হবে, তা নিয়ে কাজ করতে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সংক্রান্ত একটি চুক্তির প্রস্তাব মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। এদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে একাধিক চুক্তি সম্পাদন করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সোমবার মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে পুরনো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সু চির মন্ত্রী কোনো আশ্বাস দেননি।
মিয়ানমার মন্ত্রীর এ আশ্বাসকে বৈশ্বিক চাপ কমানোর কৌশল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি ফেরত নেয়া হতো তবে তাদের মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতো না। তারা বলেন, সু চির মন্ত্রী খিও টিন্ট যখন ঢাকায় বৈঠক করছেন, তখনও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ হয়নি। সোমবারও সকাল থেকে মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের ও পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক উপস্থিত ছিলেন। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে। বৈঠক শেষে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি সফররত সু চির দফতরের মন্ত্রী খিও টিন সোয়ে।
দেড় ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। উভয় দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে নিজেদের সদস্য নির্বাচন করে দেবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত একটি চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। নিরাপত্তার ব্যাপারে যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাবেন। নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে তিনটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) আলোচনার টেবিলে আছে। তার মধ্যে একটি এমওইউ চূড়ান্ত হয়ে আছে।’
মাহমুদ আলী বলেন, ‘এক বৈঠকেই সমস্যার সমাধান হবে না। তবে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ খুব তাড়াতাড়ি গঠিত হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। এ প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নিজেই বলেছেন, তারা কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করবেন। আমরাও এ রিপোর্টের সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে বলেছি।’
বৈঠকে উপস্থিত সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমারের মন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তারা রাখাইনের বাসিন্দা কি-না, তার কাগজপত্র যাচাই করার কথা বলেছেন। জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গারা অভিযোগ করছে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের কাগজপত্র বিশেষ করে আইডি কার্ড নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। জবাবে মিয়ানমারের মন্ত্রী বলেছেন, তাদের বাড়িঘরের ঠিকানা, আশপাশের প্রতিবেশীদের পরিচয় দিতে পারলেও তাদের ফেরত নেয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ১৯৮২ সালে কেড়ে নেয় তৎকালীন সামরিক জান্তা। তবে রাখাইনে বসবাসরত জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের আইডি কার্ড দিয়েছিল মিয়ানমার। সংশ্লিষ্টদের মতে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সুর কিছুটা নরম করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কথা বলছে। অবশ্য এ আশ্বাস কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কেননা এ ধরনের আশ্বাস দেশটি আগেও দিয়েছে। কিন্তু তা পূরণ করেনি। এবার তারা কি আন্তরিক, নাকি আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর কৌশল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিন লাখ রোহিঙ্গা অনেক বছর ধরেই আছেন। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে জঙ্গি হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর ৯ সদস্য নিহত হন। তার জের ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেয় সেনাবাহিনী। ওই সময়ে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রোহিঙ্গাদের তখনকার ঢল থামতে না থামতেই ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে জঙ্গি হামলা হয়। তারপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে গণহত্যাসহ দমন-পীড়ন শুরু করে। ফলে এক মাসে মিয়ানমার থেকে প্রায় ৫ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। রোহিঙ্গাদের ঢল এখন অব্যাহত আছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চলছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর লোমহর্ষক নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘মিয়ানমারের মন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুরনো রোহিঙ্গাদেরও ফিরিয়ে নিতে হবে। তবে পুরনোদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের মন্ত্রী কোনো আশ্বাস দেননি।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এ পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী সবকিছু অগ্রসর হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শঙ্কা ছিল, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে বৈঠকটি পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। কিন্তু তারা নতুন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এখানে বড় প্রশ্ন হল, মিয়ানমারের আশ্বাসে বিশ্বাস করা যায় না। অতীতে বিভিন্ন সময়ে তারা একইভাবে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু সেসব আশ্বাস তারা পূরণ করেননি। আমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের মন্ত্রীর হাতে দিয়েছি। এখন দেখা যাক, তারা কতটা আন্তরিকভাবে তাদের আশ্বাস পূরণ করেন।’ বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘মিয়ানমার যতটা অগ্রসর হয়েছে, তার পুরোটাই আন্তর্জাতিক চাপের ফলে হয়েছে। এখন মিয়ানমার এ ব্যাপারে কতটা কী করে, সেটা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।’বৈঠকে উপস্থিত অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান,‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বারবারই বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছে। জবাবে মিয়ানমারের মন্ত্রী বলেন, যত অভিযোগ করা হচ্ছে তত কিছু হয়নি। এখানে অতিরঞ্জিত তথ্য আছে।’
জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক : মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠকের পর পরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক। এতে স্বরাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এতে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি রুটিন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সুইজারল্যান্ড প্রতিনিধির সফর : ঢাকায় সুইজারল্যান্ড দূতাবাস জানায়, সুইস সরকারের মানবিক সহায়তা সংক্রান্ত প্রতিনিধি এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) উপমহাপরিচালক ম্যানুয়েল বেসেলার রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশকে সমর্থন ও মানবিক সহায়তা প্রদানে সুইজারল্যান্ডের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সাম্প্রতিককালে কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণকারী বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং এ সংক্রান্ত মানবিক বিপর্যয়ের ওপর সম্যক ধারণা নিতে বেসেলার বর্তমানে পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। ১ থেকে ৩ অক্টোবর কক্সবাজারে থাকাকালীন তিনি বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেনে হোলেনস্টাইনও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। পালংখালিতে রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শনকালে বেসেলার বলেন, ‘বর্তমান মানবিক সংকটে সুইজারল্যান্ড গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমি যে সমস্যাগুলো এখানে প্রত্যক্ষ করছি তা অভূতপূর্ব। এ সমস্যা সমাধানে দরকার সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা। স্থানীয় জনগণসহ সব ভুক্তভোগী মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, যেসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অধিক ঝুঁকির মুখে আছে, যেমন- সঙ্গিহীন শিশু, তাদের নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। সব ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী, যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবার প্রতি নিরপেক্ষ মানবিক সহায়তা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের সুরক্ষা দেয়ার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
রাখাইন পরিস্থিতিতে ভারত উদ্বিগ্ন: ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া এক বক্তব্যে রাখাইন পরিস্থিতিতে ভারত খুবই উদ্বিগ্ন বলে দেশটির প্রতিনিধির দেয়া বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রতিনিধি এ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিতে ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসী হামলায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক মানুষ নিহত হন। তারপর নিরাপত্তা অভিযানে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিত। বেসামরিক নাগরিকদের কল্যাণের কথা তাদের মনে রাখা উচিত। যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের নিরাপদে ফিরে যাওয়া ভারত প্রত্যাশা করে।
নি