বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে দুই দফায় ৩০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির পর তৃতীয় দফায় নতুন করে আরো ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সাহায্য করতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
বুধবার সচিবালয়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে ঋণচুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। ১৭টি প্রকল্পে ৩৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসছেন অরুণ জেটলি।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকার একমত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর জুনে ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটির চূড়ান্ত চুক্তি হতে যাচ্ছে কাল। এ নিয়ে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ভারত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি শেষ। ভারতের অর্থমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হবে।
’ প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের জন্যই এটি নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথম দিকে প্রকল্পে গতি কম থাকলেও এখন বেড়েছে। ’
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশে এটি অরুণ জেটলির প্রথম সফর। সফরকালে তিনি বৈঠক করবেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। সোনারগাঁও হোটেলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ভারতের এফআইসিসিআইয়ের যৌথ আয়োজনে ব্যবসাসংক্রান্ত সভায় যোগ দেবেন অরুণ জেটলি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার আমন্ত্রণে রাতের ডিনারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সফরকালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার কথা রয়েছে ভারতের অর্থমন্ত্রীর।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে অরুণ জেটলির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু দুই দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সময় সুবিধাজনক না হওয়ায় পরে তা বাতিল হয়। ভারতের অর্থমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজেরও বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, যে ১৭টি প্রকল্পে ৪৫০ কোটি ডলার খরচ হবে, সেগুলো চূড়ান্ত করেছে দুই দেশ। ঋণের সুদের হারসহ অন্য সব শর্ত আগের মতোই থাকবে। ঋণের সুদের হার হবে ১ শতাংশ। কমিটমেন্ট ফি হবে ০.৫০ শতাংশ। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে বাংলাদেশ এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কোনো কারণে ঋণের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে সুদের বাইরে আরো ২ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে। অবশ্য ইআরডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এযাবৎ কখনো ঋণের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হয়নি। তাই জরিমানা দেওয়ারও বিষয় আসবে না। চুক্তিতে এ ধরনের শর্ত থাকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, কংগ্রেসের শাসনামলে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় ভারত। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের সময় ভারত সরকার ওই ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৪ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে অনুদান দেয়। সাত বছর প্রায় পেরিয়ে গেলেও ৮৬ কোটি ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৫৮ কোটি ডলার। ২৮ কোটি ডলার এখনো খরচ হয়নি। ২০১০ সালের নেওয়া সাতটি প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে। কবে নাগাদ শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না। প্রথম দফায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর ধীরগতির মধ্যেই ২০১৫ সালে দ্বিতীয় দফায় ভারতের সঙ্গে ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। দ্বিতীয় দফায় ২০০ কোটি ডলার দিয়ে ১৪ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
তৃতীয় দফায় পাওয়া ৪৫০ কোটি ডলার যে ১৭ প্রকল্পে খরচ হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ অন্যত্র নেওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দর টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার, সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়ন, বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে নড়াইল-ভাঙ্গা পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, মোংলা বন্দর উন্নয়ন, মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ঢাকার রাস্তায় এক লাখ এলইডি বাতি সংস্থাপন, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা এবং বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।
ভারতের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পগুলোর সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে প্রকল্প নেওয়াতেই সমস্যা থাকে। কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। পরে মাঠপর্যায়ে গিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। এ কারণে অনেক প্রকল্প বাদও হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভারতের ঠিকাদারদের সঙ্গে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত অনেক ধাপ পেরোতে হয়। এ কারণে অনেক সময় অপচয় হয়। সে কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আলাদা চুক্তি করতেও অনেক সময় চলে যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যে পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেটি সঠিক হয়নি। পরে আবার পরিবর্তন করতে হয়।