শ্রীজগন্নাথদেব, সুভদ্রাদেবী এবং বলদেবের রথযাত্রা মহোৎসব প্রতি বছর জগন্নাথপুরীতে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথপুরীতে জগন্নাথদেব ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন একটি মন্দিরে উপাসিত হন। জগন্নাথদেবের আবির্ভাবের চমকপ্রদ কাহিনী বৈদিক শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা মালবদেশের অবন্তী নগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি ভগবানের সাক্ষাৎ লাভ করবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভগবানের প্রেরিত কোন এক বৈষ্ণব তখন শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে কথাপ্রসঙ্গে নীলমাধবের কথা তাঁকে শোনালেন। রাজা এই সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন ব্রাহ্মণকে নীলমাধবের অনুসন্ধানে প্রেরণ করলেন। কিন্তু সকলেই বিফল মনোরথ হয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। একমাত্র রাজপুরোহিত শ্রীবিদ্যাপতি বহুস্থান ভ্রমণ করতে করতে শবর নামক একটি অনার্যজাতির দেশে উপস্থিত হলেন। সেই শবরপল্লীতে উপনীত হয়ে তিনি বিশ্বাবসু নামক এক শবরের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বিশ্বাবসু তখন বাড়ীতে ছিলেন না, কিন্তু তাঁর যুবতী কন্যা ললিতা একাকিনী সেখানে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে গৃহস্বামী শবর গৃহে প্রত্যাবর্তন করে সেই ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন এবং তিনি তাঁর কন্যা ললিতাকে আদেশ দিলেন সেই ব্রাহ্মণ অতিথির সেবা করবার জন্য। বিদ্যাপতি কিছুদিন বিশ্বাবসুর গৃহে অবস্থান করলেন এবং তারপর সেই শবরের বিশেষ অনুরোধে তিনি তাঁর কন্যার পানিগ্রহণ করলেন। বিদ্যাপতি দেখতে পেলেন যে সেই শবর প্রতিদিন রাত্রে বাইরে চলে যান এবং তার পরদিন দুপুরবেলা গৃহে ফিরে আসেন, তখন শবরের শরীরে কর্পূর, কস্তুরী, চন্দন ইত্যাদির সুগন্ধ পাওয়া যায়। বিদ্যাপতি তাঁর পত্নী ললিতাকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ললিতা
জানালেন যে তার পিতা প্রত্যেকদিন নীলমাধবের পূজা করতে যান।এতদিন পরে নীলমাধবের সন্ধান পেয়েবিদ্যাপতির আনন্দের সীমা রইল না। শবরের আদেশ লঙ্ঘন করেই ললিতা পতিকে নীলমাধবের কথা জানালেন। বিদ্যাপতি নীলমাধবের দর্শনপ্রাপ্তির জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অবশেষে একদিন কন্যার বিশেষ প্রার্থনায় বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে তাঁকে নীলমাধব দর্শনের জন্য নিয়ে গেলেন। বিশ্বাবসুর কন্যা স্বামীর বস্ত্রাঞ্চলে কতকগুলি সরিষা বেঁধে দিয়েছিলেন। বিদ্যাপতি পথে সেগুলি নিক্ষেপ করতে করতে চলতে লাগলেন।
যখন বিদ্যাপতি নীলমাধবের সামনে উপস্থিত হলেন, তখন শবর বিদ্যাপতির চোখ খুলে দিলেন। বিদ্যাপতি নীলমাধবের অপূর্ব শ্রীবিগ্রহ দর্শণ করে আনন্দে নৃত্য ও স্তব করতে লাগলেন। এখানে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীনীলমাধব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং, তিনি শ্রীবগ্রিহরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। ভগবানের বিগ্রহরূপে অবতরণকে বলা হয় অর্চাবিগ্রহ। ভগবান তাঁর ভক্তদের প্রতি কৃপা করে শ্রীবিগ্রহরূপে প্রকাশিত হন। সর্বতোভাবে জড়কলুষ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত
যেহেতু ভগবানের দর্শন লাভ করা যায় না, তাই ভগবান তাঁর শ্রীবিগ্রহরূপে প্রকাশিত হন যাতে আমরা তাঁকে দর্শন করতে পারি এবং তাঁর পূজা করতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেছেন মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
অর্থাৎ, সর্বক্ষণ আমার কথা চিন্তা কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তাই ভক্তের
পূজা ও প্রণতি গ্রহণ করার জন্য ভগবান তাঁর অর্চাবিগ্রহরূপে প্রকাশিত হন। তিনি তাঁর ভক্তের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন, যাতে তাঁর প্রতি তাদের প্রীতি বর্ধিত হয় এবং তারা তাঁর সেবা করতে পারে। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ জীবদের উদ্ধার করার জন্য এটি পরমেশ্বর ভগবানের একটি বিশেষ কৃপা। এইভাবে বিদ্যাপতি শ্রীনীলমাধবের করুণা ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন। শবর বিদ্যাপতিকে নীলমাধবের কাছে রেখে পূজার উপকরণ আহরণ করার জন্য বেরিয়ে গেলেন। সেই সময় ব্রাহ্মণ দেখলেন যে একটি ঘুমন্ত কাক নিকটস্থ একটি কুন্ডে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণত্যাগ করল এবং চতুর্ভূজ মূর্তি ধারণ করে, অর্থাৎ সারূপ্য মুক্তি লাভ করে বৈকুন্ঠে গমণ করল। তা দেখে বিদ্যাপতিও সেই বৃক্ষে আরোহণ করে সেই কুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে সঙ্কল্প করলেন। সেই সময় আকাশবাণী হল, “হে ব্রাহ্মণ, তুমি যে নীলমাধবের দর্শন পেয়েছে, তা র্সবপ্রথম ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে জানাও।”শবর বনফুল ও কন্দফুল সংগ্রহ করে নিয়ে এসে
শ্রীনীলমাধবের পূজা করতে আরম্ভ করলেন। তখন নীলমাধব সেই শবরকে বললেন, “আমি এতদিন তোমার প্রদত্ত বনফুল গ্রহণ করেছি, এখন আমার ভক্ত শ্রীইন্দ্রদ্যুম ্ন মহারাজের প্রদত্ত রাজসেবা গ্রহণের অভিলাষ হয়েছে। ”শ্রীনীলমাধবের সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন ভেবে শবর তাঁর জামাতা বিদ্যাপতিকে তাঁর গৃহে আবদ্ধ করে রাখলেন। তারপর তাঁর কন্যার বিনীত প্রার্থনায় তিনি সেই ব্রাহ্মণকে মুক্তি দিলেন। ব্রাহ্মণ তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজের কাছে উপস্থিত হয়ে শ্রীনীলমাধবকে আনবার জন্য অভিযান করলেন। বিদ্যাপতির নিক্ষিপ্ত সরিষা থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদগুলি তাঁদের পথ প্রদর্শণ করল, কিন্তু সেখানে গিয়ে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীনীলমাধবের বিগ্রহ না পেয়ে তাঁর সৈন্য- সামন্ত নিয়ে শবর-পল্লী অবরোধ করলেন এবং
বিশ্বাবসুকে বন্দী করলেন। তখন রাজার প্রতি আকাশবাণী হল, “বিশ্বাবসুকে ছেড়ে দাও। নীলাদ্রির উপর তুমি একটি মন্দির নির্মান কর, সেখানে দারুব্রহ্মরূপে তুমি আমার দর্শন পাবে। নীলমাধব মূর্তিতে তুমি দর্শন পাবে না। ” মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন মন্দির নির্মান করবার জন্য বাউলমালা নামক স্থান থেকে প্রস্তর আনবার ব্যবস্থা করে সেখান থেকে নীলকন্দর পর্যন্ত একটি পথ নির্মান করলেন। ঐ পথে প্রস্তর আনয়ন করে শঙ্খনাভি মন্ডলে তিনি একটি মন্দির নির্মাণ করালেন এবং সেখানে রামকৃষ্ণপুর নামক একটি গ্রাম স্থাপন করালেন। সেই মন্দির মাটির নীচে ৬০ হাত ও মাটির উপর ১২০ হাত উঁচু করা হল। মন্দিরের উপর একটি কলস ও তার উপর একটি চক্র স্থাপিত হল এবং মন্দিরকে সুবর্ণমন্ডিত করা হল। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ শ্রীব্রহ্মাকে দিয়ে সেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করাবার অভিলাষ করে ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হয়ে বহুকাল ধরে ব্রহ্মার অপেক্ষা করতে লাগলেন। সেই সময়ের মধ্যে ইন্দ্রদ্যুম্নের নির্মিত মন্দির সমুদ্রের বালুকার দ্বারা আবৃত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সুরদেব এবং তারপর গালমাধব নামক কয়েকজন রাজা সেখানে রাজত্ব করলেন। গালমাধব বালির নীচ থেকে সেই মন্দিরটি উদ্ধার করলেন। এদিকে ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মার কাছ থেকে তাঁর রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে সেই মন্দিরটি তাঁর নির্মিত বলে দাবী করায় গালমাধব তা মেনে নিতে অস্বীকার করলেন এবং সেই মন্দিরটি তিনি বানিয়েছেন বলে জানালেন। কিন্তু মন্দিরের নিকটবর্তী কল্পবটস্থিত ভূষন্ডি কাক–যিনি যুগযুগান্তর ধরে শ্রীরামনাম কীর্তন করতে করতে সেখানে সমস্ত ব্যাপার দর্শন করছিলেন, তিনি জানালেন যে ওই মন্দিরটি ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ নির্মাণ করেছেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে তা বালুকায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, রাজা গালমাধব পরে তা উদ্ধার করেছেন। গালমাধব সত্যের অপলাপ করায় ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরের পশ্চিমে শ্রীমন্দিরের বর্হিদেশে ব্রহ্মার নির্দেশে অবস্থান করলেন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মাকে এই পরম মুক্তিদায়ক ক্ষেত্রে ভগবানের মন্দির প্রতিষ্ঠা করবার জন্য প্রার্থনা জানালে ব্রহ্মা বললেন, “শ্রীভগবানের স্বরূপশক্তির দ্বারা প্রকাশিত এই শ্রীক্ষেত্র ও স্বপ্রকাশ শ্রীভগবানকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা আমার নেই। শ্রীজগন্নাথ ও তাঁর শ্রীধাম এই প্রপঞ্চে তাঁরই কৃপায় নিত্য বিরাজমান, তবে আমি এই মন্দিরের চূড়ায় একটি পতাকা বেঁধে দিচ্ছি। যারা দূর থেকে ওই পতাকা দর্শন করে দন্ডবৎ প্রণাম করবে তারা অনায়াসে মুক্তিলাভ করবে।”ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ নীলমাধবের দর্শন না পেয়ে অনশনব্রত অবলম্বনপূর্বক প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প করে
কুশশয্যায় শয়ন করলেন। তখন জগন্নাথদেব স্বপ্নে তাঁকে বললেন, “তুমি চিন্তা করো না, সমুদ্রের ‘বাঙ্কিমুহান’ নামক স্থানে দারুব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে আমি উপস্থিত হব।” রাজা সৈন্য সামন্তসহ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং শঙ্খ-
চক্র-গদা-পদাঙ্কিত শ্রীদারুব্রহ্ম দর্শন করলেন। রাজা বহু বলবান লোক, হাতি প্রভৃতি নিযুক্ত করেও সেই দারুব্রহ্মকে জল থেকে তুলতে পারলেন না। তখন শ্রীজগন্নাথদেব রাজাকে স্বপ্নে জানালেন,
“আমার পূর্বসেবক বিশ্বাবসু, যে আমার শ্রীনীলমাধব স্বরূপের পূজা করত, তাকে এখানে আনো এবং একটি সুবর্ণ রথ দারুব্রহ্মের সম্মুখে স্থাপন কর।”রাজা সেই স্বপ্নাদেশ অনুসারে কাজ করতে আরম্ভ করলেন। শবর
বিশ্বাবসু এসে শ্রীদারুব্রহ্মের একদিক এবং ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি অপরদিক ধারণ করলেন। তখন চতুর্দিকে সকলে হরিনাম-সংকীর্তন করতে লাগলেন। রাজা শ্রীদারুব্রহ্মের শীচরণ ধরে রথে আরোহণ করলে রাজা mতাঁকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এলেন। সেখানে শ্রীব্রহ্মা যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, বিঘ্ন-বিনাশকারী শ্রীনৃসিংহদেব তখন যজ্ঞবেদিতে অবস্থান করেছিলেন। কথিত আছে যে যেখানে আজ মন্দির বর্তমান, সেইখানে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মুক্তি-মন্ডপের সংলগ্ন পশ্চিমদিকে যে নৃসিংহদেব বিরাজমান আছেন, তিনি সেই আদি ‘নৃসিংহদেব।’ মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই দারুব্রহ্মকে শ্রীমূতিরূপে প্রকট করবার জন্য বহু দক্ষ শিল্পীকে আহ্বান করলেন, কিন্তু তারা কেউই দারুব্রহ্ম স্পর্শই করতে পারল না, তাদের ,অস্ত্র-শস্ত্র সমস্তই খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেল। অবশেষে স্বয়ং ভগবান ‘অনন্ত মহারাণা’ নামে আত্মপরিচয় প্রদান করে ,একটি বৃদ্ধ শিল্পীর ছদ্মবেশে সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে একুশ দিনের মধ্যে দ্বাররুদ্ধ করে শ্রীবিগ্রহ প্রকটিত করবেন, এই প্রতিশ্রুতি দান করলেন। এদিকে যে সমস্ত কারিগর রাজার আহ্বানে সেখানে আগমণ করেছিল, সেই বৃদ্ধ সূত্রধরের উপদেশ অনুসারে রাজা তাদের দ্বারা তিনটি রথ প্রস্তুত করালেন। সেই বৃদ্ধ কারিগর দারুব্রহ্মকে শ্রীমন্দিরের ভিতরে নিয়ে
গিয়ে দ্বাররুদ্ধ করে একাকী অবস্থান করবেন এবং একুশ দিনের পূর্বে কিছুতেই রাজা দ্বার উন্মোচন করতে পারবে না, এই প্রতিজ্ঞা করলেন। কিন্তু দু’সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর কারিগরের অস্ত্র-শস্ত্রাদির কোন রকম শব্দ না পেয়ে রাজা অত্যন্ত উৎকন্ঠিত হয়ে ,পড়লেন। মন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও রাণীর পরামর্শ ,অনুসারে রাজা স্বহস্তে সেই মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত ,করলেন। সেখানে বৃদ্ধ কারিগরকে দেখতে পেলেন না, কেবল দেখলেন–দারুব্রহ্ম তিনটি শ্রীমূতিরূপে বিরাজ
করছেন। তাঁদের সামনে গিয়ে তিনি দেখলেন শ্রীমূর্তির ,শ্রীহস্তের আঙ্গুলগুলি এবং শ্রীপাদপদ্ম প্রকাশিত হয়নি। বিচক্ষণ মন্ত্রী তাঁকে জানালেন, সেই বৃদ্ধ কারিগর আর কেউই নন, তিনি স্বয়ং জগন্নাথ। রাজা নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট সময়ের এক সপ্তাহ পূর্বেই শ্রীমন্দিরের দ্বার উন্মোচন করায় শ্রীজগন্নাথ নিজেকে এইভাবে প্রকটিত করেছেন। রাজা তখন নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে করে প্রাণত্যাগ করবার সঙ্কল্প করে কুশশয্যায় শয়ন করলেন। অর্ধরাত্রে শ্রীজগন্নাথদেব রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দান করে বললেন, “আমি এইরূপে ‘শ্রীপুরুষোত্তম’ নামে শ্রীনীলাচলে নিত্য অধিষ্ঠিত আছি। এই প্রপঞ্চে আমি আমার শ্রীধামের সঙ্গে চব্বিশটি অর্চাবতার রূপে অবর্তীর্ণ হই। আমি প্রাকৃত হস্ত-পদ রহিত হলেও অপ্রাকৃত হস্ত-পদাদির দ্বারা ভক্তের প্রদত্ত সেবোপকরণ গ্রহণ করি এবং সমস্ত জগতের মঙ্গলের জন্য বিচরণ করি বেদের এই নিত্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার জন্য তুমি যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছ, সে সম্বন্ধে একটি লীলামাধুরী প্রকট করবার জন্য আমি এই মূর্তিতে প্রকটিত হয়েছি। পেমাঞ্জনচ্ছুরিত ভক্তিবিলোচনেন আমার মাধুর্য-রসলুব্ধ ভক্তরা আমাকে ‘শ্রীশ্যামসুন্দর মুরলীবদন’ রূপে দর্শণ করেন। আমার ঐশ্বর্যময়ী সেবায় যদি তোমার অভিলাষ হয় তা হলে তুমি স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত হস্ত-পদ আদির দ্বারা আমাকে কখনও কখনও ভূষিত করতে পার; কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও জেনে রেখো যে আমার শ্রীঅঙ্গ যাবতীয় ভূষণের ভূষণ স্বরূপ।”রাজা স্বপ্নে শ্রীজগন্নাথদেবের এই বাণী শ্রবণ করে কৃতার্থ হলেন এবং প্রার্থনা জানালেন, “যে বৃদ্ধ কারিগর এই শ্রীমূর্তি প্রকট করেছেন তাঁর বংশধরেরা যেন যুগে যুগে জীবিত থেকে তিনটি রথ নির্মানকার্যে ব্যাপৃত থাকেন।” শ্রীজগন্নাথদেব ঈষৎ হাস্য করে বললেন, “তাই
হবে।”
তারপর শ্রীজগন্নাথদেব রাজাকে আরও বললেন, “যে বিশ্বাবসু নীলমাধবরূপী আমার সেবা করতেন, তার বংশধরেরা যুগে যুগে আমার ‘দয়িতা’–সেবক নামে পরিচিত থেকে সেবা করবে। বিদ্যাপতির ব্রাহ্মণপত্নীর গর্ভজাত বংশধরেরা আমার অর্চক হবে, আর বিদ্যাপতির শবরীর গর্ভজাত সন্তানেরা আমার ভোগ রন্ধন করবে। তারা ‘সুয়ার’ (সুপকার) নামে খ্যাত হবে।”মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীজগন্নাথদেবকে বললেন, “আমাকে একটি বর দান করতে হবে। প্রতিদিন মাত্র এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘন্টা আপনার শ্রীমন্দিরের দ্বার রুদ্ধ থাকবে, আর জগৎবাসী সকলের দর্শনের জন্য অবশিষ্ট সময় আপনার শ্রীমন্দিরের দ্বার মুক্ত থাকবে। সারাদিন আপনার ভোজন চলবে আপনার হস্তপল্লব কখনও শুষ্ক হবে না।” শ্রীজগন্নাথদেব ‘তথাস্তু’ বলে সম্মত হলেন এবং বললেন, “এখন তোমার নিজের জন্য কিছু বর প্রার্থনা কর।” তখন রাজা বললেন, “যাতে কোন মানুষ আপনার শ্রীমন্দিরকে নিজ সম্পত্তি বলে দাবী করতে না পারে, সেজন্য আমি নির্বংশ হতে চাই–আমাকে সেই বর দান করুন।” শ্রীজগন্নাথদেব ‘তথাস্তু’ বলে রাজাকে এই বরও প্রদান করলেন।এইভাবে পরম করুণাময় শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, সুভদ্রাদেবী এবং বলদেব সমস্ত জীবের মঙ্গলের জন্য এই জড় জগতে আবির্ভূত হলেন। তাঁদের এই আবির্ভাবের ফলে জীবের কি কল্যাণ সাধিত হল?
সেই কথা বৃহন্নারদীয় পুরাণে বর্ণনা করে বলা হয়েছে প্রতিমাং তত্রতাং দৃষ্টা স্বয়ং দেবেন নির্মিতম। অনায়াসেন বৈজান্তি ভবনং মে তত নরাঃ ॥
অর্থাৎ, পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ লক্ষ্মীদেবীকে বললেন, “পুরুষোত্তম-ক্ষেত্র নাম ধামে আমার স্বর্ণনির্মিত ‘কেশব-বিগ্রহ’ বিরাজমান। মানুষ যদি কেবল সেই শ্রীবিগ্রহ দর্শন করে, তাহলে তারা অনায়াসে আমার ধামে, আমার কাছে ফিরে আসতে পারে।”এইভাবে শ্রীজগন্নাথদেব সমস্ত জগৎ উদ্ধার করবার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। বিশেষ করে তিনি যখন সকলের চোখের সামনে রথে চড়ে যান, তখন তাঁর সেই রথারূঢ় অবস্থা দর্শণ করে জীব পুঞ্জীভূত পাপরাশি থেকে মুক্ত হতে পারে।
রথযাত্রা এবং সামাজিক ঐক্য: পুরীকে পুরুষত্তোম ক্ষেত্র বলা হয়। এখানকার রথ যাত্রায় দিন কোন ভেদাভেদ থাকে না। ধনী,দরিদ্র, উচু, নিচু, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য সবাই এক কাতারে ভগবানকে নিয়ে রাজ পথে নামে। আর আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান সবার এবং সবাইকে একত্রিত হতে। কারণ ভগবান সকলেরৱ, ভগবানে সবার সমান অধিকার । গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সবাইকে নিয়ে কীর্তন করতে রথযাত্রায় অংশ নিতেন। তাছাড়া প্রভাষখন্ড থেকে জানা যায় যে পুরীতে অভক্তু থেকে বিগ্রহ দর্শন করা যাবে না। আগে প্রসাদ খেতে হবে পরে দেব বিগ্রহ দর্শন। এখন ও এ নিয়মচলে আসছে। পুরীকে শঙ্খক্ষেত্রও বলা হয় কারণ মানচিত্রে একে শঙ্খের মত দেখতে লাগে । নীলাচলে লবণাক্ত সমুদ্র-উপকূলে শ্রীপুরুষোত্তম ভগবান্ জগন্নাথ দারুব্রহ্মরূপে নিত্যবিরাজমান আছেন। স্বয়ং শ্রীলক্ষ্মীদেবী তাঁর ভোগান্ন রন্ধন করেন এবং পরম দয়ালু প্রভু তা ভোজনান্তে তাঁর ভক্তগণকে অধরামৃত দানে ধন্য করে থাকেন। আর এতেই সেই ক্ষেত্রবাসী ভক্তগণ দেবদুর্লভ অন্ন লাভ করে ধন্যাতিধন্য হন। প্রভু জগন্নাথের সেই প্রসাদ-অন্নের নাম ‘মহাপ্রসাদ’। এই প্রসাদ যে কেহ যে কোন অবস্থায় স্পর্শ করলে বা যে কোন স্থানে নীত হলেও কোনরূপ বিচার না করে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা উচিৎ। অহো! শ্রীজগন্নাথদেব বা তাঁর অন্ন মহাপ্রসাদ মাহাত্ম্য দূরে থাকুক, সেই ক্ষেত্রের এমনই মাহাত্ম্য যে তথাকার গর্দভও চতুর্ভূজরূপে পরিদৃষ্ট হয়ে থাকেন। সেই পরম পবিত্র শ্রীজগন্নাথক্ষেত্রে প্রবেশ মাত্রই কোন জীবের আর পুনর্জন্ম লাভ করতে হয় না। সেই প্রফুল্ল পুণ্ডরীকাক্ষকে এই চক্ষুদ্বারাই দর্শন করলেও জন্ম সার্থক হয়। শ্রীদারুব্রহ্ম পুরুষোত্তমের শ্রীমুখারবিন্দে বিশাল নয়নযুগল অপরূপ শোভা ছড়াচ্ছে, শ্রীকপোল ভাগ মণিময় তিলকে বিভূষিত এবং শ্রীঅঙ্গ নবজলধর কান্তির ন্যায় পরিশোভিত; তাঁর অরুণকান্তি অধরের দীপ্তিতে শ্রীমুখমণ্ডল পরম রমণীয়ব্যঞ্জক ও মন্দ মন্দ হাস্যচন্দ্রিকার দ্বারা আপামর জনগোষ্ঠির অপার আনন্দ বর্দ্ধন করছে।
স্বয়ং শ্রীগৌরসুন্দরই নীলাচলের পুরীধামক্ষেত্রের
অচলব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথদেব রূপে প্রকটিত। আবার তিনিই
সচলব্রহ্ম রূপে শ্রীশ্রীনীলাচল বিভূষণ গৌরহরি।
শ্রীসনাতন গোস্বামীপাদ তাই বলেছেন- শ্রীমৎ-
চৈতন্যদেব ত্বাং বন্দে গৌরাঙ্গসুন্দর।শচীনন্দন মাং
ত্রাহি যতিচূড়ামণে প্রভো ॥ আজানুবাহঃ স্মেরাস্য
‘নীলাচলবিভূষণ’। জগৎ-প্রবর্তিত-স্বাদু ভগবৎ-নাম কীর্তন
॥ (শ্রীলীলাস্তব, সংখ্যা ১০৪) শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের
রথারোহণের পর থাকার মণ্ডপকে বলা হয় গুণ্ডিচা। উরিষ্যার স্থানীয় লোকজন গুণ্ডিচা যাত্রা বলেন। কাকতালীয় ভাবে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নীর নামও ছিল গুণ্ডিচা। জগন্নাথদেবের রথখানিকে গণ্ডিচা গমনের পর আবার অষ্টম দিবসে নিজ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। এক বলে উল্টো রথ যাত্রা। ভারতবর্ষে রথযাত্রার উৎসব অতি প্রাচীন।
পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলাস্থ শ্রীরামপুর মাহেশে সবচেয়ে প্রাচীনতম, আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি ৬১২ বৎসরের পুরানো উৎসবানুষ্ঠান। গুপ্তিপাড়ায় ৪০২ বছরের প্রাচীন দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা। বারুইপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের ৩০১ বৎসরের অধিক রথযাত্রার উৎসব উল্লেখযোগ্য। বিধাননগর কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়। বাগবাজারে বলরাম মন্দিরের রামকৃষ্ণ মঠে ১১২ বৎসরের অধিক ঐতিহাসিক রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও রথযাত্রার উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। রথযাত্রা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য মিলন মেলা। এই দিনে এখানে নানা ধর্ম-বর্ণের লোক জগন্নাথদেবের মূর্তি এক নজর দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে সমায়েত হয় রথ-চত্বরে। জগন্নাথদেবও তাঁর জগৎজনকল্যাণময় মূর্তি নিয়ে মন্দিরের পূজাবেদী হতে বেরিয়ে এসে রথারোহণে যাত্রা শুরু করে দেন। বৎসরে একবার দর্শন দিয়েও তিনি অসংখ্য ভক্তের চিত্তবিহারী হয়ে ভক্তহদয়ে অবস্থান করেন।
রাজধানী ঢাকায় ৫০০ বৎসরের পুরানো সূত্রাপুরের রামসীতা মন্দির কমিটির আয়োজনে অনেকদিন যাবৎ রথযাত্রার অনুষ্ঠান চলে আসছে। এছাড়া পুরান ঢাকায় শ্রীশ্রীরাধামাধব জিও দেববিগ্রহ মন্দির, ঠাটারীবাজার শিবমন্দির ও রাধাগোবিন্দ জিও ঠাকুর মন্দিরেও রথযাত্রার অনুষ্ঠান চলে আসছে। ঢাকায় সবচেয়ে বড় রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শ্যামবাজার ইসকন্ মন্দিরে। জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর তিনখানি সুসজ্জিত রথ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে ইসকন্ মন্দির হতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় আবার অষ্টম দিবসে উল্টোরথ যাত্রা হিসেবে রথ তিনটিকে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রার উৎসব। কোন কোন সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৪০০ বৎসর ধরে চলে আসছে ধামরাইয়ের রথযাত্রার অনুষ্ঠান।
ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরের পরিচালনাপর্ষদের বর্তমান সম্পাদক রাজীবপ্রসাদ সাহার মতে, প্রায় ২০০ বছর আগে ধামরাইয়ের যশোমাধব রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হয়।
কিংবদন্তী আছে, পালবংশের শেষ রাজা যশোবন্ত পাল একদিন গজে আরোহণ করে ধামরাইয়ের শিমুলিয়ায় বেড়াতে আসেন। পথে শিমুলিয়ার উপকণ্ঠে একটি লাল মাটির ঢিবির কাছে এসে রাজার হাতি থেমে যায়। পরে রাজার আদেশে ঐ মাটির ঢিবি খনন করে একটি মন্দিরের সন্ধান মেলে। ঐ মন্দিরটিতে মাধব বিগ্রহসহ আরও কিছু বিগ্রহ পাওয়া যায়। রাজা যশোবন্ত পাল সকল বিগ্রহ সংগ্রহ করে শিমুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে পূজার জন্য স্থাপন করেন। রাজা মূল বিগ্রহটিকে ধামরাইয়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন ব্রাহ্মণকে দায়িত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজার নাম সংযুক্ত করে মন্দিরের নাম হয় যশোমাধব মন্দির। এখানেই মাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানটির নাম হয়েছে মাধববাড়ি। প্রথমে একটি কুঁড়েঘরে মাধবের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল বলে জানা যায়; আর মাধবের রথখানিও ছিল তখন বংশদণ্ডনির্মিত। পরে কবে কোন সময় মাধরের কুঁড়ের ঘরের মন্দিরের স্থলে পাকা দালান ও বংশদণ্ড রথের বদলে কাঠের রথ তৈরী হয়েছিল তাঁর সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
জনশ্রুতি আছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৫০ জন দক্ষ কাষ্ঠশিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধামরাইয়ের প্রথম কাঠের রথখানি তৈরী হয়েছিল। এই কাঠের রথে নানা কারুকার্যখচিত মহাভারতের কাহিনী ও কলিকালচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ৩২ চাকার উপর প্রতিষ্ঠিত রথখানির উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে উহা ছিল যথাক্রমে ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুট। তিনতলা বিশিষ্ট রথখানিতে সুদৃশ নয়টি কক্ষ থাকায় উহাকে নবরত্ন রথ বলা হত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হানাদার বাহিনীর দোসরদের কালছোবলে ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথখানি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর পর আগের রথের আদলে আর একটি রথ তৈরীর প্রয়াস থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি নানা কারণে। পরে ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আর একটি রথ তৈরী হয় যা বর্তমানে ধামরাইয়ের রথ হিসেবে আজও বিদ্যমান। শ্রীশ্রীজগন্নাথ-দেবের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে নানা উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে জগন্নাথদেব হলেন পাপবিমোচনকারী সাক্ষাৎ বিষ্ণুর অবতার। জনশ্রুতি আছে যে ধামরাইয়ের এতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন রথের মেলা শুরু হয়েছিল ১০৭৯ বাংলা সনে। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে দশ দিনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আসে রথ যাত্রার মেলা। প্রতি বছর যশোমাধবের বিগ্রহ মাধবমন্দির থেকে রথে উঠিয়ে ধামরাই পৌর এলাকায় গোপনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। রথের এ যাত্রাকে বাবার বাড়ী থেকে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা বলে বিশ্বাস করা হয়। রথখোলায় গোপনগরে দশদিন অবস্থান করার পর দশম দিনে আবার উল্টোরথ যাত্রার মাধ্যমে যশোমাধবকে আবার মাধবমন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন মহাউদ্ধারণ মঠের আয়োজনে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের শ্রীমূর্তি রথে চড়িয়ে রথযাত্রা করা হয়। সিলেট, ঢাকা দক্ষিণে শ্রীগৌরসুন্দর ও শ্রীকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ একই রথে প্রতিস্থাপন করে সাড়ম্বরে রথযাত্রার উৎসব প্রতিপালন করা হয়। রথযাত্রা শেষে ঐ বিগ্রহদ্বয় আবার ঢাকাদক্ষিণ মহাপ্রভুর পিতৃনিবাস ঠাকুরবাড়ির শ্রীমন্দির বেদীতে ফিরিয়ে আনা হয়। আজকাল পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই সাড়ম্বরে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বড় বড় শহরের রাজপথে, যেমন নিউইয়র্ক, সান্ ফান্সিসকো, টোকিও, মস্কো আদি বড় বড় শহরের রাজপথে ইস্কনের পরিচালনায় রথযাত্রার উৎসব প্রতিপালিত হয়ে আসছে।