নেই ভবনের চাকচিক্য, আবার নেই আসবাবের বাহুল্যও, দীনতার ছাপ যেনো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটিমাত্র পাকা ভবন, তারও চুন-সুড়কি উঠে লোহার রড হা করে বেরিয়ে আছে। বাকি যা আছে সবই মরিচা ধরা, টিনের বেড়ার ঘর। শেয়াল-কুকুর একদিকে ঢুকে আরেকদিকে বেরিয়ে যায় অনায়াসে।
এমনই যখন করুণ অবস্থা সেই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে উপকূলীয় জেলা বরগুনার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের পদক অর্জন করে অন্যদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বলছিলাম আমতলীর আলীরবন্দর এমএ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা।
শনিবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে স্কুলটির পাশদিয়ে যাওয়া ভবনের ছাদে একদল ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষককে বই হাতে দেখে চোখ আটকে গেলো। তবে দূর থেকে বিষয়টি পুরোপুরি অনুমান করা যাচ্ছিল না। ছাদে শিক্ষার্থীদের আড্ডা-নাকি অন্যকিছু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের বহনকারি গাড়িটি অনেকদূর এগিয়ে গেলো। সামনে যাওয়ার তাড়া থাকলেও ফিরোজ চৌধুরী গাড়ি ফেরানোর জন্য নির্দেশ দিলেন ড্রাইভারকে।
আমতলী-তালতলী পাকা সড়ক থেকে একটি সরু ইট বিছানো সড়ক স্কুল মাঠে গিয়ে ঠেকেছে। সেই পথ ধরে গাড়ি যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় পায়ে হেঁটে যতোই এগোচ্ছি- ততই বিদ্যালের দীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। প্রথম পূর্বমূখী ঘরটি টিনের বেড়া টিনেই ছাউনি। এরপর উত্তরমূখী একটি একতলা একাডেমিক ভবন। ২০০০ সালে নির্মিত এই ভবনটিই একমাত্র পাকা ঘর। যার ওপর সেই শিক্ষার্থীদের জটলা। মাঠে পা দিয়ে জানা গেলো শ্রেণি কক্ষ সংকটের কারণে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ভুগোল ক্লাস নিচ্ছেন সহকারি শিক্ষক জামাল হোসেন।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো, সিঁড়ির গোড়ায় আনাচে-কানাচে অনেকগুলো বিছানা। বন্যায় বাস্তুহারা লোকজন যেভাবে ঠাঁই করে নেয়। তেমনি যে যেখানে পেরেছে বিছানা করে নিয়েছে মাথা গোঁজার জন্য। শীতের হাত থেকে বাঁচতে বিছানার চাদর দিয়ে ঘিরে দিয়েছে থাকার বিছানাটি। বেডগুলোতে কয়েকজন ছাত্রকে শুয়ে পড়তে দেখা গেলো।
ওপরে উঠে ক্লাসের ফাঁকে কথা বলতে চাইলে একজন শিক্ষার্থী কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললেন, অনেকে এসে ছবি করে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমাদের কষ্ট দূর হয়নি। দেখেন এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তাই পা মোড়া দিয়ে বসেছি। বেশিক্ষণ কি এভাবে বসে থাকা যায়? আমাদের শ্রেণিকক্ষ নেই। আবার বেঞ্চও নেই। যেখানে বসে ক্লাস করতে পারি।
প্রধান শিক্ষক জামাল হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, একাডেমিক ভবনে তিনটি রুম রয়েছে। এক রুমে প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক, এরপর কম্পিউটার ল্যাব, তৃতীয় রুমে নবম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। একাডেমিক ভবনের সঙ্গে একটি বর্ধিত রুমে দশম শ্রেণির ক্লাস চলে। পেছনে দু’টি টিনসেড ঘর রয়েছে। টিনের বেড়ার বেহাল অবস্থা। এখানে কোনো মানুষ থাকে- দূর থেকে এটা অনুমান করাও কঠিন। দেখলেই পরিত্যাক্ত কোনো ভবন বলে মনে হবে। এর একটিতে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস চলে অপরটিতে কয়েকজন আবাসিক ছাত্র থাকেন।
স্কুলের প্রবেশ পথে তুলনামুলক নতুন টিনের দু’টি কক্ষে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। যা চলতি বছরে স্কুলের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু রোদে বেড়া ও ছাউনির টিন এতো গরম হয়। ফ্যান থাকলেও কক্ষের মধ্যে টেকা কষ্টকর হয়। বিশেষ করে গরমের সময়ে এই রুমগুলোতে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা হয় বলে জানালেন শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু এমনই দীনতার মধ্যে চলমান স্কুলটির ফলাফলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। গত বছর ১২০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাশ ও ২০ জন জিপিএ ফাইভ অর্জন করে। আরও অনেকগুলো ক্যাটাগরিতে অন্যদের টেক্কা দিয়ে বছরের শ্রেষ্ঠ উপজেলা ও জেলার পদক ছিনিয়ে এনেছে। শুধুই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অদম্য মনোবল। এবারও তারা ভালোফল অর্জনের জন্য এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দিনরাতে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। যেহেতু স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলমান। তাই ১শ’ জোড়া বেঞ্চের সবটাই পরীক্ষার জন্য দিতে হয়েছে। সে কারণে তাদের ঠাঁই হয়েছে ছাদে।
প্রধান শিক্ষক জানালেন, একাডেমিক ভবনটি সম্প্রসারণের জন্য সম্প্রতি টেন্ডার হওয়ার খবর জানতে পেরেছেন। সঙ্গে আসবাবপত্র দেওয়া গেলে তারা আরও ভালো কিছু করার সামর্থ্য রাখেন।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে বর্তমানে ৬৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। কাছাকাছি কোনো স্কুল না থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছে বিদ্যালয়টি অন্ধের ষষ্টির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকরা ভবনের জন্য অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। আশা করছেন তাদের দুঃখের দিনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।