প্রসব বেদনা নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। তিনটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরেও স্থান হয়নি আসন্ন প্রসবা পারভিনের। অবশেষে রাস্তার ওপরই তার সন্তান প্রসব হয়েছে। তবে জন্মের পরপরই পারভিনের শিশুসন্তানটি মারা যায়। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীর আজিমপুর ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান’ এর সামনে ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার আগে পারভিন নামে ওই নারী ওই হাসপাতালে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হতে গেলে তাকে ভর্তি না নিয়ে বের করে দেয় হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে দালালদের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।
পারভিনের সাথে হাসপাতালে যাওয়া সোহেল নামে এক যুবক সাংবাদিকদের জানান, পারভিনের গ্রামের বাড়ি যশোর জেলায়। বেশ কয়েক মাস আগে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এর পর থেকে পারভিন গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারে থাকতেন। সোহেল বলেন, আমিও তাকে চিনি না। সোমবার রাত ৩টার দিকে তার ব্যথা শুরু হয়। এ সময় তিনি সোহেলের হাত-পা ধরে কেঁদে ফেলেন এবং তাকে হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ করেন। তখন তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সোহেল। সেখানে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করে বলেন, তার স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে। চিন্তার কারণ নেই।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আবার পরীক্ষা করে জানান, পারভিনের সিজার করাতে হবে। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাদের ওখানের (ঢামেক) চেয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভালো চিকিৎসক রয়েছেন। তারা ডেলিভারি রোগীর ভালো চিকিৎসা প্রদান করেন। এসব বলে তারা পারভিনকে মিটফোর্ডে প্রেরণ করে। ভোর ৫টার দিকে পারভিনকে মিটফোর্ডে নেয়ার পর তারাও পরীক্ষা করে বলেন, সিজারে বাচ্চা হবে। কিন্তু তাদের ওখানে ভালো হবে না। তারা পারভিনকে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে বলেন। সেখান থেকে সকাল সোয়া ৮টার দিকে মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে যান পারভিন।
কিন্তু সেখানে তার নামে কার্ড কিংবা রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তারা পারভিনকে ভর্তি নেবে না বলে জানান। পারভিন আর টিকতে পারছে না, যেকোনো মুহূর্তে সন্তান প্রসব হয়ে যাবে বলে তাদের অনুরোধ করলে তাকে দ্বিতীয় তলার লেবার রুমে নিয়ে যায়। তখন লেবার রুমে কনসালট্যান্ট ডা: নিলুফা দায়িত্বরত ছিলেন। সোহেল বলেন, লেবার রুমে নেয়ার পর এক নারী চিকিৎসক এসে তাদের বলেন, এর (পারভিন) তো সিজার করতে হবে। ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। তোমাদের কাছে কত টাকা আছে?
তখন পারভিন ও সোহেল তাদের কাছে টাকা নেই বলে জানালে তাৎক্ষণাৎ ওই চিকিৎসক চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের পোশাক পরিহিত এক আয়া এসে পারভিনের হাত ধরে নিচে নামিয়ে দিতে টানাহেঁচড়া করতে থাকেন। তিনি বলেন, আপনার চিকিৎসা এখানে হবে না, আপনি অন্য হাসপাতালে যান। না হয় ঢামেকে যান, আমরা ফোন করে দিচ্ছি। এই বলে আয়া তাকে টেনে নিচতলায় আনেন। তখন পারভিনের ব্যথা আরো বেড়ে যায়। হাঁটতে পারছিলেন না। নিচে আনার পর পারভিন বের হতে না চাইলে গেটের দারোয়ানরাও তাকে টেনে বের করে দেয়।
এ সময় পারভিন ৪-৫ কদম যেতেই তিনি মাটিতে পড়ে যান। এবং ব্যথার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী, স্বজন ও রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। দূরে বসে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ দৃশ্য দেখছিলেন।পারভিনকে কোনো রকম দাঁড় করিয়ে আবার ৩-৪ পা যেতেই তিনি আবার মাটিতে পড়ে যান এবং কাতরাতে থাকেন। এ সময় হঠাৎ করে তার সন্তান প্রসব হয়। পরে আশপাশের কয়েকজন মহিলা এসে চার দিকে কাপড় ধরে কাজটি শেষ করেন এবং পুত্রসন্তানটিকে একজনের হাতে নেন। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দুই মিনিটের মতো হাত-পা নাড়াচ্ছিল। তখনো হাসপাতালের গেটে ও দোতলার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কয়েকজন নারী ডাক্তার, নার্স ও দারোয়ান বিষয়টি দেখছিলেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। মিনিট দুয়েক পর শিশুটির দেহ হঠাৎ নিথর হয়ে যায়।একজন অসহায় মায়ের এই করুণ দৃশ্য দেখেও হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা কেউ এগিয়ে আসেননি। কাঁদতে কাঁদতে সোহেল বলেন, এমন দৃশ্য দেখে আমার কান্না চলে আসে। পারভিনের চিৎকার আর শিশুটির মৃত্যুর দৃশ্য দেখে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই কেঁদে ফেলেন। শিশুটি মারা যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা গণমাধ্যম ও পুলিশকে জানানোর কথা বললে হাসপাতালের দু’জন স্টাফ একটি ট্রলি নিয়ে এসে পারভিনকে একটি রুমে চিকিৎসা দেয়।তারা শিশুটিকে নিতে চাইলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দেননি। তারা বলেন, এখানে পুলিশ ও সাংবাদিকরা আসবেন, তারা এসব দেখার পর তাকে দেয়া হবে। এভাবে ৪০ মিনিটের মতো সময় শিশুটির নিথর দেহ কনক্রিটের ওপর পড়ে থাকে। এ বিষয়ে সোহেল বলেন, কী করব বুঝতে পারছি না। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। এ সময় পুলিশ আমাকে বলে, মামলা করে কী লাভ! তোমাকেই মাসে কয়েকবার আদালতে দৌড়াতে হব! প্রান্তহালদার