সিনেমা সংস্কৃতি চর্চা এবং প্রকাশের একটি অংশ। সেই সঙ্গে দেশ ও দশের ভিন্ন এবং অভিন্ন কথা তুলে ধরে। সিনেমার দৃশ্যে দৃশ্যে উঠে আসে মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা। যুগে যুগে এমন রীতিই হয়ে আসছে।
এরই মধ্যে অনেক কিছু হারিয়ে যায় যা ছবি নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকই তা ভুলে যান। অথবা সার্বিক ব্যস্ততার মধ্যে হাত দেয়া হয় না। তেমনই একটি বিষয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা আসলে কতটা স্বাধীন? আমরা কেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি? কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়েছে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের?
তা এ প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা এবং কীভাবে জানবে সে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকে জানতে পারছেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিজয়ের প্রেরণা, কীভাবে স্বাধীন হলাম, কেমন ছিল স্বাধীনতার আগের জীবন ব্যবস্থা?
তা সহজ ও সঠিকভাবে একমাত্র ছবি নির্মাতারাই দেখাতে ও জানাতে পারেন। ঠিক যেমন জানিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তার ‘গেরিলা’ ছবিতে। এ সময়ের মুক্তিযুদ্ধের একটি পরিপূর্ণ ছবি এটি।
তবে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ করতে যে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্ম হতে হবে তা নয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের নির্মাতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের প্রতি আগ্রহ একেবারেই কম।
তারা কেন বা মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করছেন না? কেউ কেউ ভাবছেন, সঠিক তথ্যভিত্তিক গল্পের অভাব। কেউ বলছেন যুদ্ধভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করা কঠিন। আবার কেউ কেউ ভাবছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি বা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ করবেন?
এ প্রসঙ্গে তরুণ নির্মাতা অনন্য মামুন বলেন, ‘আসলে প্রথম কথা হচ্ছে ছবি বানিয়ে কোথায় কাকে দেখাব? আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরেই পর্যাপ্ত সিনেমাহল নেই।
যেগুলো আছে সেগুলোয় দর্শক বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। সে জন্য আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানানো হয় না। তবে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করব।’
শুধু সিনেমা হলই নয়। মুক্তিযুদ্ধের একটি ছবি বানাতে প্রথমে দরকার একটি সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য গল্প। এখনকার গল্পকাররা সে অর্থে গল্প লিখছেন না। যা লিখছেন তা অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
এ বিষয়ে তরুণ নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, ‘বর্তমানে অনেকেই আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা দেখেছেন, তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে চান। আমাদের বয়স সে সংখ্যায় পৌঁছেনি। তাই অনেকেই হয়তো আমাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে চাইছেন না। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প হল এ বিষয়ে ছবি নির্মাণের পূর্ব শর্ত।
কিন্তু আমাদের বিশ্বাসযোগ্য গল্প দেবে কে? আর সে মাফিক ছবি বানাতে বাজেটই বা কে দেবে?’
মুক্তিযুদ্ধের গল্প থাকলেও সে পরিমাণ বাজেট যেমন হয় না তেমনই পরিবেশ একটি মুখ্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের একটি দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার আগে সেরকম পরিবেশ তৈরি করা দরকার। যুদ্ধচলাকালীন সে পরিবেশ এখন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে নির্মাতা বুলবুল বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের দেশের পরিবেশ আগের চেয়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে যে পরিবেশ দরকার সে পরিবেশ তৈরি করা এখন কঠিন। আর কঠিন পরিবেশ তৈরি করাটাও ব্যয়বহুল। একটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি কিন্তু শুধু প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বানানো যায় না। সে পরিপ্রেক্ষিতে বড় আকারে বাজেট দরকার। গল্প পরিবেশ এবং বাজেট পর্যাপ্ত না থাকলে একটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ সম্ভব নয়।’
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ করতে গল্পের সত্যতার একটি বিষয় রয়েছে বলে মনে করেন নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস। তার মতে, বাজেট এবং পরিবেশ ঠিক থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি হতে হবে সত্য ও তথ্যনির্ভর।
তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। আমরা যদি সত্য ও তথ্যনির্ভর মুক্তিযুদ্ধের গল্প না পাই, তবে কেন আমরা ছবি নির্মাণ করব? আর এ জাতীয় ছবিতে অর্থ বিনিয়োগকারী পাওয়াই যায় না।’
অন্যদিকে আরেকটি বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ নির্মাতা বলেন, ‘কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়েও একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পী স্বাধীন বাংলাদেশের কেউ নন। সব মিলিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। আমাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে পারছি না। আবার ঝুঁকি নিয়ে একটি ছবি বানালাম, কিন্তু এ ছবি দেখাব কোথায়?
এখন এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে আর দেরি নয়, কিছুদিন পর মোবাইলে দেখার জন্য ছবি বানানো হবে। সিনেমা হলের জন্য ছবি কেউ বানাবে না। কারণ সিনেমা হলে গিয়ে যে দর্শক ছবি দেখবে সেই পরিবেশ এখন আর নেই। তবে আমার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে একটি হলেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাব।’