জ্যৈষ্ঠের প্রলয়ংকরী ঝড়ের রাতে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ধূমকেতুর আলোকবর্তিকা নিয়ে এক দরিদ্র পরিবারে যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি আমাদের ‘জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম’ । কবি নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর সৃষ্টিশীলতার ব্যাপ্তিতে তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর অন্য হাতে রণ-তূর্য, তিনি না হিন্দুর না মুসলিমের, তিনি যেমনি রচনা করেছিলেন কীর্তন- শ্যামাসংগীত তেমনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ছিল মোহনীয় গজল। তাঁর সৃষ্টিসুরের মূর্ছনা সকল ধর্ম গোত্রের মানুষের হৃদয়ানুভূতির অনুপ্রেরণা – তাঁর সুরের লহরী যেন এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষের হৃদয়ের সেতুবন্ধন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রেমের কবি এবং দ্রোহের কবি – জন্মেই যার অন্তরে ছিল বিদ্রোহের দাবানল। আমাদের জাতীয় কবির কবিতায় ও গানে আছে বিদ্রোহের লেলিহান শিখা যার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে শাসকের রক্তচক্ষু ভুলন্ঠিত করে দেওয়ার সকল প্রকার উপাদান, আবার হৃদয় নিংড়ানো প্রেমানুভুতির পরশ দিয়ে তিনি রচনা করেছেন তাঁর গান আর কবিতা। তাই তিনি প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি।
যাঁর কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িকতা, ভেদাভেদহীনতা, তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন এক মানবিক সমতার সমাজ গড়ার যার পরতে পরতে থাকবে সাম্যবাদ, সমাজে মানুষের পরিচয় হবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের সকল ভেদাভেদের উর্দ্বে, পাশাপাশি তাঁর মননে লালন করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে ভারত মাতাকে মুক্ত করার দৃঢ় অংগীকার। মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল তার বজ্রধ্বনি। যাঁর সৃষ্টিশীলতায় – প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা প্রতিভাত হয়েছিল, তাঁরই ক্ষিপ্র তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে – সেই তারুণ্যই শতদল হয়ে ফুটেছিল তাঁর কাব্যিক জীবনে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যেমনি ছিল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা তেমনি ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে ছিল দাবানলের হল্কা -ছিল অধিকার বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি অন্তরে লালন করেছিলেন এক ‘পরাধীনতার শৃঙ্খল’ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা যেখানে থাকবে না মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ, থাকবে না হিন্দু-মুসলিম বিরোধ। তাঁর ‘ধূমকেতু’ আর ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থদ্বয় ব্রিটিশ শাসকদের রীতিমতো হৃদকম্প তৈরী করে দিয়েছিলো – সত্যি বলতে কি দ্রোহের কবিকেই মানায় এই কথা বলতে ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর’।
আজকের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার অসঙ্গতি, সামাজিক অবক্ষয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে এক শ্রেণীর স্বার্থানেষী গোষ্ঠীর নগ্ন হস্তক্ষেপ, মানুষে মানুষে হানাহানি, এক জনের সম্পদের প্রতি অন্যের লোলুপ দৃষ্টি, এক কথায় সকল প্রকার অনাসৃষ্টিতে নজরুলের মত একজন সাম্যের অথচ বিদ্রোহের কবির আমাদের খুব প্রয়োজন যাঁর কবিতায়, গানে সাহিত্যে আমাদের নব প্রজম্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে পথ প্রদর্শন করবে।