রাজধানীর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করার মাধ্যমে রাজনীতির ‘মহীরুহ’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে চিরবিদায় জানিয়েছে দেশ। স্বজন ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাঁদিয়ে কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের এই উত্তরসূরি।
নীতির প্রশ্নে আপসহীন আওয়ামী লীগের দু’বারের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের তিন দফা জানাজার প্রতিটিতে নামে লাখ লাখ মানুষের ঢল। সততা, নির্লোভ আর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আশরাফ শেষযাত্রায় শ্রদ্ধা পান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চার অগ্রদূত’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আত্মপ্রচার, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ভেদ-বৈষম্য কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন। দলের মতাদর্শের ঊর্ধ্বে সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মহৎপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় সৈয়দ আশরাফের জানাজার পর হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানে দুপুর সাড়ে ১২টায় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুপুর ২টায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাঁ মাঠে তৃতীয় জানাজা শেষে গণমানুষের হৃদয় স্পর্শকারী এই নেতার মরদেহ ঢাকায় এনে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার নামাজে জানাজায় অংশ নেন মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এছাড়া দেশের লাখ লাখ সাধারণ জনগণ জানাজায় অংশ নেন।
কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে টানা পাঁচবার নির্বাচিত এমপি সৈয়দ আশরাফ গত ৩ জানুয়ারি ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। বিমানবন্দরেই এই মুক্তিযোদ্ধার কফিন ঢেকে দেয়া হয় জাতীয় পতাকায়। সেখান থেকে ৬৭ বছর বয়সী আশরাফের মরদেহ বেইলি রোডের সরকারি বাসায় নিয়ে আসা হয়। রাতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয় তাকে।
সংসদ ভবনে বোবা কান্নায় রাজনৈতিক সহকর্মীরা: একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার জন্য সময় চেয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। রোববার তিনি সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে আসলেন কিন্তু শপথ নিতে নয়, আসেন কফিনবন্দি হয়ে। সকালে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অশ্রু চোখে বিদায় জানান তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা।
সকাল ১০টার দিকে সংসদ ভবনে তার মরদেহ নিয়ে আসার পর সেখানে জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়া কফিনে ফুল দিয়ে এই নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মী আশরাফের জানাজায় অংশ নিয়ে স্মরণ করেন তাদের ‘দুঃসময়ের কান্ডারীকে’। শেষ বিদায়ের আগে একাত্তরের রণাঙ্গনে মুজিব বাহিনীর এই যোদ্ধার প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান।
সংসদ প্লাজায় এমপি বা সাবেক এমপিদের জানাজায় সাধারণ যত মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, সৈয়দ আশরাফের জানাজায় উপস্থিতি ছিল কয়েক গুণ বেশি। দক্ষিণ প্লাজার ওপরের চত্বর পূর্ণ হয়ে সিঁড়ি এবং সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। মানুষের এই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
সকাল সাড়ে ১০টার কিছু আগে সৈয়দ আশরাফের কফিন সংসদ চত্বরে আনার পর একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। পরে আশরাফের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী আশরাফের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সংসদ সচিবালয় জামে মসজিদের ইমাম আবু রায়হানের পরিচালনায় জানাজা ও মোনাজাত শেষে সৈয়দ আশরাফের মরদেহে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
জানাজার আগে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন আশরাফের ছোট ভাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এসময় উপস্থিত ছিলেন।
এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবুল হাসনাত আবদুল্লাাহ, ইলিয়াস মোল্লাহ, আসলামুল হক ও সাদেক খান। মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্য ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বেসামরিক-সামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন সৈয়দ আশরাফের জানাজায়।
লাখো মানুষের ঢল ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার জানাজায়: সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজার পর হেলিকপ্টারে করে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ নেয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীতে থাকা সৈয়দ আশরাফকে কিশোরগঞ্জের মানুষ তাদের জনপ্রতিনিধি করে সংসদে পাঠিয়েছে পাঁচবার। ভালোবাসার এই মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত তার জানাজায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ঢল নামে। কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে লাখো মানুষ তার জানাজায় শরিক হন। জানাজায় অংশ নিতে ঈদগাহ মাঠ ছাড়িয়ে পাশের রাস্তায় লোকজন চলে যায়।
জানাজার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে বাঙালি মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান একজন রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারি। ওয়ান ইলেভেনের সময় চরম বৈরি পরিবেশে দলের হাল ধরে তিনি জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তির বন্দরে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিক। বিশ্বাস-অনুভূতির গভীর স্পর্শে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পরম আপনজন। ‘আজও মহাসিন্ধুর ওপাড় থেকে ভেসে আসে তার সে অমর বাণী- আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই, এটা একটা দল এটা কোনোদিনও ভাবি নাই। আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতির নাম।’
বনানী কবরস্থানে দাফন: কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জানাজা শেষে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ আনা হয় ঢাকায়। বাদ আছর রাজধানীর বনানী কবরস্থানের এ ব্লকে তার দাফন সম্পন্ন হয়। সৈয়দ আশরাফকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বনানী কবরস্থানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। ছিলেন সৈয়দ আশরাফের পরিবারের সদস্যরাও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা জানান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র, বনানী থানা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দাফন শেষে সৈয়দ আশরাফের চাচাতো ভাই এবং কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু দেশবাসীর কাছে তার ভাইয়ের জন্য দোয়া কামনা করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে প্রবাসে বসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আশরাফ। এরপর ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে পুননির্বাচিত হন। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন হাসপাতালে থেকেই। বৃহস্পতিবার নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে আসতে না পারায় সময় চেয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলেন আশরাফ। সেদিন রাতেই ব্যাংককে তার মৃত্যু হয়।