সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে
সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ
করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়; সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ
সংক্রমণ। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নুতন সাজে,
নুতন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বুঝায়। বাস্তবেও তা-ই দেখা
যায়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর,
কুম্ভ এবং মীন।এই বারটি একটির পর আরেকটি চক্রাকারে অবর্তিত হতে থাকে।
রাশিচক্রস্থ দৃশ্যমান গমন পথ যাকে ক্লান্তিবৃত্ত বলে; সেপথে সূর্য গমনের
ফলে (জ্যোতিষতত্ত্বমতে) পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন
রূপ ধারণ করে। এভাবে পৃথিবী নানারূপে সঞ্চারের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট
প্রতিমাসে পরিবর্তিত হতে থাকে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এধরনের পরিবর্তনের মধ্যে
সনাতন ধর্মের অনুসারীগণের মধ্যে চারটি দিন উল্লেখযোগ্য। তন্মমধ্যে দুই অয়ন
এবং দুই বিষুব দিন। দুই অয়ন হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন এবং বিষুব হল মহাবিষুব
ও জলবিষুব। চৈত্র সংক্রান্তিতে মহাবিষুব ও আশ্বিন সংক্রান্তিতে জলবিষুব
আরম্ভ হয়। উল্লেখ্য বছরে যে দুইদিন দিবা ও রাত্রি সমান হয় তাকে বিষুব দিন
বলা হয়। বসন্তকালে যে বিষুব হয়, তাকে মহাবিষুব আর শরৎকালে যে বিষুব হয় তাকে
জলবিষুব বলা হয়। মৎস্যপুরাণেও তাই বলা হয়েছে-।।।তিনটি ত্রসরেণু অতিক্রম
করতে সূর্যের যে সময় নেয়, তাকে ত্র“টি বলে। এরকম একশত ত্র“টিতে একটি লব,
তিন লবে এক নিমেষ, তিন নিমেষে এক ক্ষণ (১.৬ সেকেন্ড) হয়। পাঁচ ক্ষণে এক
কাষ্ঠা (৮ সেকেন্ড), পনের কাষ্ঠাতে এক লঘু (২ মিনিট), পনের লঘুতে এক নাড়ি
(৩০ মিনিট), ছয় নাড়িতে এক প্রহর (৩ ঘন্টা) আর অষ্টপ্রহরে এক দিনরাত (৩ঢ৮=২৪
ঘন্টা) হয়। পনের দিন-রাতে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, ছয় মাসে এক অয়ন আর
দুই অয়নে এক বছর হয়। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় এই ছয় মাস
উত্তরায়ন কাল এবং শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ এই ছয়
মাস দক্ষিণায়ন কাল। সেজন্য আষাঢ়ের সংক্রান্তিতে দক্ষিণায়ন এবং পৌষ
সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণ শুরু হয়। অয়ন ভেদে সুর্যেরও দিক পরিবর্তন হয়।
উত্তরায়ণে সুর্যের সঞ্চার হওয়া মাত্র সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে এবং
দক্ষিণায়ণে পুনরায় সূর্য দক্ষিণ দিকে সঞ্চার হতে আরম্ভ করে ।পৌষ মাসের
সংক্রান্তিকেই বলা হয় উত্তর সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। ।।শাস্ত্র মতে
উত্তরায়ণে মৃত্যু হলে মুক্তি প্রাপ্তি হয় এবং দক্ষিণায়ণে মৃত্যু হলে ঘটে
পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ তাঁকে আবার সংসারে ফিরে আসতে হয়। সূর্য এ দিনই ধনু
রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।।।।
পুরাণ অনুযায়ী, মকর
সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই মহাভারতের পিতামহ ভীস্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু
গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের
যুদ্ধ শেষ হয়েছিল।
বিষ্ণুদেব অসুরদের বধ করে তাঁদের কাটা মুন্ডু
মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন, তাই মকরসংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ
শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও মানা হয়ে থাকে।
আবার অন্য মতে, সূর্য এ দিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক
মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা ছেলের সম্পর্কের একটি
বিশেষ দিন হিসাবেও ধরা হয়।